Ad
Advertisement
Doctor TV

শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫


শীত ও স্বাস্থ্য: কাশি, জ্বর ও মশাবাহিত রোগে সতর্কতার গুরুত্ব

Main Image

ছবিঃ সংগৃহীত


বাংলাদেশে শীত মৌসুম ধীরে ধীরে নেমে আসে গরমের পরই। রাজধানী ঢাকায় শীত ততটা স্পষ্টভাবে অনুভূত না হলেও দেশের উত্তরাঞ্চল, উপকূলীয় জেলা ও গ্রামীণ এলাকাগুলোতে এই সময়টা বেশ ঠান্ডা পড়ে। শীতের অনুভূতি অনেকের কাছে আরামদায়ক—গরমের ক্লান্তি দূর হয়, বাতাসে থাকে প্রশান্তির ছোঁয়া। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত আছে কিছু বাড়তি স্বাস্থ্যঝুঁকি, যা প্রায় প্রতিবছরই দেখা যায় এবং এ সময়ে শিশু, বয়স্ক, ডায়াবেটিস রোগী ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতাসম্পন্ন মানুষের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে শরীর দ্রুত খাপ খাওয়াতে না পারলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং ঠিক সেই দুর্বলতার সুযোগেই ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অ্যালার্জেনগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে।

 

ঠান্ডাজনিত সমস্যা: কাশি, জ্বর ও অ্যাজমা বৃদ্ধি

শীতের শুরুতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ঠান্ডাজনিত রোগ। মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাজমা রোগীদের জন্য এ সময়টা বেশি বিপজ্জনক, কারণ শীতের শুকনো বাতাস শ্বাসনালীকে সংকুচিত করে এবং ধুলাবালির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া অ্যালার্জি বাড়িয়ে তোলে। শহরাঞ্চলে যানবাহনের ধোঁয়া, নির্মাণকাজের ধুলা ও বাতাসে ভেসে থাকা ধাতব কণার কারণে শ্বাসকষ্ট, কাশি এবং নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো ব্যাপক হারে দেখা দেয়। অনেক শিশু ও বয়স্ক মানুষ ঠান্ডাজনিত খুসখুসে কাশি, কোল্ড অ্যালার্জি বা বারবার জ্বরের মতো সমস্যায় আক্রান্ত হন। এসব সমস্যা সময়মতো নজরে না আনলে তা নিউমোনিয়ায় রূপ নিতে পারে—বিশেষত যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বা বয়স বেশি।

 

শীতেও মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধি

শীতকালে মশাবাহিত রোগও উপেক্ষা করা যায় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, ডেঙ্গু কেবল বর্ষাকালেই সীমাবদ্ধ নেই; জলাবদ্ধতা, তাপমাত্রা ওঠানামা ও আবহাওয়ার বৈচিত্র্যের কারণে শীতকালেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এছাড়া দেশের কিছু এলাকায় ফাইলেরিয়া ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ এ সময় বাড়তে পারে, বিশেষ করে যেখানে মশার জন্মক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা রয়েছে। উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর, শরীরে ব্যথা, গিঁটে ব্যথা বা কাঁপুনি দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

 

ত্বকের অতিরিক্ত শুষ্কতা

শীতের আরেকটি সাধারণ সমস্যা হলো ত্বকের অতিরিক্ত শুষ্কতা। শীতের বাতাসে আর্দ্রতা কমে যায়, ফলে ত্বক দ্রুত শুকিয়ে খসখসে হয়ে ওঠে। অনেকে চুলকানি বা হালকা ব্যথাও অনুভব করেন। যাদের ত্বকে ধুলাবালি বা ঠান্ডার প্রতি অ্যালার্জি রয়েছে, তারা এ সময় আরও বেশি সমস্যায় পড়েন। নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার—যেমন লোশন, গ্লিসারিন, নারিকেল তেল বা অলিভ অয়েল—ত্বককে আর্দ্র রাখে এবং শুষ্কতার কারণে সৃষ্ট ক্ষতি কমায়।

 

শিশু ও বয়স্কদের পাতলা পায়খানা

শীতকালে শিশু ও বয়স্কদের পাতলা পায়খানাও তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। হঠাৎ শরীরে ঠান্ডা লাগা, অপরিষ্কার পানি পান, বাইরে তৈরি খাবার খাওয়া অথবা ভাইরাসজনিত সংক্রমণ এসব সমস্যার কারণ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সময়ে খাবার অবশ্যই গরম বা কুসুম গরম রাখতে হবে এবং শিশু-বয়স্কদের গরম পোশাক, মোজা ও হাতমোজা পরানো অত্যন্ত জরুরি। বাইরে থেকে এসে ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধোয়া বা গোসল করাও অনেক সময় জটিলতা বাড়াতে পারে। কুসুম গরম পানি শরীরকে শীতের বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা করে।

 

ডায়াবেটিস ও দীর্ঘমেয়াদি রোগীদের অতিরিক্ত সতর্কতা

শীতকালে ডায়াবেটিস রোগী ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্তদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেশি। তাপমাত্রা কমে গেলে রক্তচাপ ওঠানামা করতে পারে, রক্তে সুগারের মাত্রা অস্থিতিশীল হতে পারে এবং শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ দ্রুত ধরতে পারে। অনেকের অনিদ্রা, জয়েন্টের ব্যথা, হাত-পায়ের শক্তভাবও বেড়ে যায়। এ কারণে নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, ওষুধ যথাযথভাবে সেবন করা এবং গরম কাপড়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

শীতকালে যেসব ভুল এড়ানো উচিত

শীতকালে সবচেয়ে বেশি যে ভুল মানুষ করে তা হলো ঠান্ডা পানি ব্যবহার, অতিরিক্ত ঠান্ডা খাবার খাওয়া, যথেষ্ট পানি না পান করা, বা বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার না করা। অথচ শীতের সময় শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা ধরে রাখতে পানি অত্যন্ত জরুরি। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন লেবু, কমলা, মাল্টা বা জলপাই ইত্যাদি প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকলে সর্দি-কাশির ঝুঁকি কমে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শীতের ভোরের রোদে কয়েক মিনিট দাঁড়ানো শরীরের জন্য উপকারী, কারণ সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ডি উৎপাদন বাড়ে যা হাড় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয়। এ ছাড়াও নিয়মিত হাঁটা-দৌড়ানো বা ব্যায়াম শরীরকে উষ্ণ রাখে এবং ঠান্ডাজনিত অসুস্থতা কমায়।

 

সব মিলিয়ে বলা যায়, শীত বাংলাদেশের মানুষের কাছে একদিকে স্বস্তি এনে দিলেও অন্যদিকে এটি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভরপুর এক সময়। একটু সচেতনতা, সঠিক পোশাক ব্যবহার, পরিমিত খাবার, কুসুম গরম পানি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সময়মতো চিকিৎসা—এই কয়েকটি বিষয়ই পারে শীতকালকে করে তুলতে অঘটনহীন, নিরাপদ ও আরামদায়ক।

আরও পড়ুন