ছবিঃ প্রতীকী
বিশ্বজুড়ে স্কুলপড়ুয়া শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে স্থূলতা এখন অপুষ্টির চেয়ে বেশি সাধারণ হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি ৮০ লাখ শিশু স্থূলতায় আক্রান্ত। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর খাবারের সহজলভ্যতা এবং জাঙ্ক ফুডের আগ্রাসী বিপণন।
২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের গবেষকরা যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তার ভিত্তিতেই এই প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ২০১৭ সালেই ধারণা দিয়েছিলেন যে অচিরেই বিশ্বের শিশুদের মধ্যে স্থূলতা অপুষ্টিকে ছাড়িয়ে যাবে। সেই ধারাবাহিকতায় ইউনিসেফের হিসাব বলছে, গত দুই দশকে শিশু-কিশোরদের স্থূলতার হার তিনগুণ বেড়েছে ২০০০ সালে যা ছিল ৩ শতাংশ, ২০২২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৯.৪ শতাংশে। অপরদিকে ৫–১৯ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপুষ্টির হার কমেছে ১৩ শতাংশ থেকে নেমে ৯.২ শতাংশে। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, আজ অপুষ্টি মানে শুধু কম ওজন নয়, শিশুদের স্থূলতাও এখন সমান বড় হুমকি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের প্রতি ১০ জন স্কুলপড়ুয়া শিশুর মধ্যে অন্তত একজন স্থূলতায় ভুগছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী এরা দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিল রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগসহ অন্যান্য অসুখে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে শিশুকালে শুরু হওয়া এই স্বাস্থ্য সংকট প্রাপ্তবয়স্ক জীবনেও নানা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অঞ্চলভেদে স্থূলতা ও অপুষ্টির চিত্র ভিন্ন হলেও দেখা যাচ্ছে, সাহারা-দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়া ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলে স্থূলতার হার অপুষ্টিকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু দ্বীপদেশে পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক—যেমন নিউই ও কুক দ্বীপপুঞ্জে ৫–১৯ বছর বয়সী প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু স্থূলতায় আক্রান্ত। ধনী দেশগুলোও এ প্রবণতা থেকে মুক্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ২১ শতাংশ শিশু-কিশোর স্থূল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে কিশোরদের জন্য নতুন প্রজন্মের ওজন কমানোর ওষুধও চিকিৎসকরা প্রয়োগ শুরু করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের স্থূলতার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার যেখানে থাকে চিনি, লবণ ও অস্বাস্থ্যকর চর্বি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এসব খাবারের লাগাতার বিজ্ঞাপন। ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় ১৭০টি দেশের ৬৪ হাজার তরুণ-তরুণীর মধ্যে ৭৫ শতাংশ জানিয়েছেন যে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা কোমল পানীয়, স্ন্যাকস বা ফাস্ট ফুডের বিজ্ঞাপন দেখেছেন। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতেও প্রায় ৭০ শতাংশ তরুণ একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের গ্লোবাল হেলথ বিভাগের অধ্যাপক ক্রিস ভ্যান টুলেকেন বলেন, স্থূলতা শিশু বা তাদের বাবা-মায়ের ব্যর্থতা নয়, এটি মূলত বিষাক্ত খাদ্য পরিবেশের ফল।
শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইউনিসেফ সরকারগুলোর কাছে জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অস্বাস্থ্যকর খাবারের বিজ্ঞাপনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, স্কুলে জাঙ্ক ফুড বিক্রি নিষিদ্ধকরণ এবং শিশুদের স্বার্থকে কর্পোরেট মুনাফার ঊর্ধ্বে রাখা। বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা হলো, এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ২১শ শতকে স্থূলতা-সম্পর্কিত রোগগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হতে পারে।
আরও পড়ুন