ছবিঃ প্রতীকী
মানবদেহের ভেতর অনেক সময় নীরবে বেড়ে ওঠে এক অদৃশ্য শত্রু উচ্চ কোলেস্টেরল। প্রথম দিকে সে কোনো আওয়াজ তোলে না, কোনো যন্ত্রণা দেয় না। কিন্তু সময়ের স্রোতে জমতে থাকে রক্তের ভেতর এক বিপজ্জনক বোঝা। এই অতিরিক্ত লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL) যাকে আমরা “ক্ষতিকর কোলেস্টেরল” বলি—ধীরে ধীরে ধমনীর দেয়ালে প্লাকের আস্তরণ ফেলে। ধমনীগুলো সংকুচিত হয়, শক্ত হয়ে ওঠে, আর রক্তপ্রবাহ হারায় স্বাভাবিক গতি। চিকিৎসাশাস্ত্রে এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস।
কোলেস্টেরলের এই নীরব দখলদারিত্ব শরীরের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গগুলিকে বিপন্ন করে তোলে—হৃদ্যন্ত্র, মস্তিষ্ক, কিডনি কিংবা পরিপাকতন্ত্র। একদিন হঠাৎ করে এর ফলাফল দেখা দেয় হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার মতো ভয়াবহ রূপে।
উচ্চ কোলেস্টেরলের ৭টি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি
১. করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD)
মার্কিন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ (NIH)-এর এক গবেষণা অনুযায়ী, উচ্চ কোলেস্টেরল হলো করোনারি আর্টারি ডিজিজের (CAD) প্রধান কারণ। এ অবস্থায় হৃদপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীগুলোতে প্লাক জমে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত করে। ফলে বুকে চাপ বা ব্যথা (অ্যাঞ্জাইনা) দেখা দিতে পারে।
অনেক সময় CAD কোনো লক্ষণ ছাড়াই থাকে এবং হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়ে বিপদ ডেকে আনে। লক্ষণগুলো হলো বুকে চাপ, ব্যথা বাহু বা চোয়ালে ছড়িয়ে পড়া, শ্বাসকষ্ট ও অতিরিক্ত ঘাম। প্রাথমিক অবস্থায় কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়।
২. ইস্কেমিক স্ট্রোক
যখন প্লাক মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীগুলোকে আটকে দেয়, তখন ইস্কেমিক স্ট্রোক হয়। এতে মস্তিষ্কের কিছু অংশ অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত হয়।
লক্ষণগুলো হঠাৎ শুরু হয় শরীরের এক পাশে দুর্বলতা, মুখ বেঁকে যাওয়া, অস্পষ্ট কথা, বিভ্রান্তি বা দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া। স্ট্রোক স্থায়ী অক্ষমতার কারণ হতে পারে, তাই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ স্ট্রোক প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।
৩. পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ (PAD)
PAD তখন হয় যখন পায়ে বা হাতে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীগুলোতে প্লাক জমে যায়। সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ হলো হাঁটার সময় পায়ে ক্র্যাম্প বা ব্যথা হওয়া, যা বিশ্রামে কমে যায়।
অন্যান্য লক্ষণ হলো ঝিমঝিম, অবশভাব, ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া বা ত্বকের রঙ পরিবর্তন। চিকিৎসা না করলে পায়ে রক্ত চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়ে টিস্যু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই প্রাথমিক পর্যায়েই নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
৪. রেনাল আর্টারি স্টেনোসিস
কিডনি রক্ত ছেঁকে শরীরের চাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু কিডনির ধমনীগুলোও প্লাকের আক্রমণ থেকে রেহাই পায় না।
প্রথম দিকে উপসর্গ না থাকলেও পরে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না আসা এবং কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়া (ক্রিয়েটিনিন বৃদ্ধি) দেখা দেয়। অবহেলায় এটি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ কিংবা কিডনি বিকল হওয়ার কারণ হতে পারে। তাই হৃদ্যন্ত্র ও কিডনি রক্ষায় কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. ক্রনিক মেসেন্টেরিক ইস্কেমিয়া
উচ্চ কোলেস্টেরল অন্ত্রের রক্ত সরবরাহেও প্রভাব ফেলতে পারে। এতে খাবার খাওয়ার ১৫-৩০ মিনিট পর পেটে ব্যথা শুরু হয়। ফলে খাবার খেতে অনীহা তৈরি হয় এবং অচেতনভাবে ওজন কমতে থাকে।
যদি রক্তপ্রবাহ খুব বেশি কমে যায়, তবে অন্ত্রের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জীবননাশের ঝুঁকি তৈরি হয়। সময়মতো রোগ চিহ্নিত করা এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি।
৬. উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন)
উচ্চ কোলেস্টেরল ও উচ্চ রক্তচাপ প্রায়ই একসঙ্গে দেখা দেয়। প্লাক ধমনীগুলোকে শক্ত ও সংকীর্ণ করে তোলে, ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। এভাবে উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল পরস্পরকে আরও খারাপ করে তোলে।
অবহেলায় হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি রোগ এমনকি চোখের দৃষ্টিশক্তিও নষ্ট হতে পারে। তাই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখলে রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
৭. জ্যানথোমা (Xanthomas)
অন্য জটিলতার তুলনায় জ্যানথোমা চোখে দেখা যায়। এটি হলো ত্বকের নিচে শক্ত, হলদেটে ফোড়া বা গাঁট, যা সাধারণত গোড়ালির টেন্ডন, কনুই বা হাতে হয়।
এটি বেশি দেখা যায় ফ্যামিলিয়াল হাইপারকোলেস্টেরোলেমিয়া নামে পরিচিত বংশগত রোগে আক্রান্তদের মধ্যে। জ্যানথোমা নিজে ক্ষতিকর না হলেও এটি খুব বেশি মাত্রার কোলেস্টেরলের সতর্কবার্তা যা অবিলম্বে চিকিৎসা প্রয়োজন করে।
উচ্চ কোলেস্টেরল কেবলমাত্র একটি রক্তপরীক্ষার ফল নয় এটি ধীরে ধীরে ধমনীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, কিডনি সমস্যা ও রক্তসঞ্চালনজনিত জটিলতার বড় ঝুঁকি তৈরি করে। অনেক সময় বুকে ব্যথা, পায়ে ক্র্যাম্প বা ত্বকে পরিবর্তনের মতো লক্ষণ দেখা দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ ছাড়াই সমস্যা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তবে সুখবর হলো খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে ওষুধের মাধ্যমে কোলেস্টেরল কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণই দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
অস্বীকৃতি: এই প্রবন্ধটি কেবল সাধারণ তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্যে লেখা। এটি কোনোভাবেই চিকিৎসকের পরামর্শ, রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার বিকল্প নয়। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আরও পড়ুন