ডা. আব্দুর রবঃ
কিছুদিন আগে একজন রুগীর ছোট একটা অপারেশন করেছিলাম, পিঠে। এক সপ্তাহ পরে যখন ইনফেকশন নিয়ে রুগী আবার ফিরে আসলো, তখন কৌতুহল নিয়ে কি কি ওষুধ খেয়েছে সেইটা খুজতে গেলাম। আমি এন্টিবায়োটিক হিসেবে হেলথকেয়ার কোম্পানির সেফালোস্পোরিন সেকেন্ড জেনারেশন এর কম্বাইন্ড ড্রাগ দিয়েছিলাম।
রুগী সেই একই এন্টিবায়োটিক খেয়েছে তবে নাম না জানা এক কোম্পানির। সেই ওষুধ কোম্পানি ও তার ট্রেড নেম আমি বিগত আমার ১২ বছরের ডাক্তারি জীবনে একবারের জন্যও শুনিনি। সত্যিই বলছি দেখিওনি।
প্রশ্ন হল:: দোকানদার কেন এদেশের একটা টপ কোম্পানির ওষুধ পালটিয়ে অখ্যাত এক কোম্পানির ওষুধ ধরিয়ে দিয়ে রুগীর সর্বনাশ করল?
মজা আছে এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই। হেলথকেয়ারের ওষুধ বেচে দোকানদার লাভ করবে ৫-৮ টাকা প্রতি পিচ ( ৮-১০% কমিশন হিসেবে)।
কিন্তু নাম না জানা কিছু কোম্পানির প্রতি ট্যাবলেট বিক্রি করে দোকানদার লাভ করবে ৩০-৪০ টাকা। দোকানদারের দোষ কম। ব্যবসার সাধারন ল ও ইন্টিউশনই সে কাজে লাগিয়েছে। আমার দোকান থাকলেও হয়ত আমি এটাই করতাম। দিন শেষে আমার চোখ থাকবে মুনাফার দিকে। কিন্তু ডাক্তার হিসেবে আমার ধান্দা পুরোটাই নির্ভর করবে রুগী সূস্থ হওয়ার উপর। আমার সুনাম, চেম্বার প্র্যাক্টিস, রুগীর ভীড়, সবকিছুই নির্ভর করবে রুগী সূস্থ হওয়ার উপর। দলে দলে ইনফেকশন নিয়ে রুগী ফিরে আসলে চেম্বারে তালা দিয়ে আমাকে অটো চালাতে হবে। আমার হিসেবে এদেশের জনপ্রিয় সকল ডাক্তার ভালো কোম্পানির নির্ভরযোগ্য ওষুধগুলোই লিখে। না লিখেও উপায় নেই। কেননা আমাদের পুজিই হলো রুগী সূস্থ হবে এবং সেই সুনামে নতুন নতুন রুগী আসবে এবং চেম্বারে ভীড় বাড়বে। ডাক্তারী পেশায় সুনাম অর্জন করতে হলে এই নিয়ম ও সূত্রের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
......প্রশ্ন হচ্ছে অখ্যাত কোম্পানির ওষুধ এদেশে চলবে কেন?? সকল সম্ভবের প্রিয় এই দেশে মাঝে মাঝেই নকল ওষুধের চালান ধরা পড়ে। বিপনন কারী এবং ওষুধের দোকানদার ও আটক হয়। গত বছর ইনজেকশন নকলের দায়ে একদল গ্রেফতার হয়েছিল কেরানীগঞ্জ এ ( পেথিডিন ওষুধের নকল)। এই নকল ওষুধের দাম কম। ওষুধ প্রশাসনের কথা আলাদা করে বলে আপনাদের হাসাইতে চাই না।
আরো একটা কারন আছে... ওষধ তৈরির প্রাথমিক কাচামালের ( API) উপর দাম অনেক টা নির্ভর করে। এই কাচামালের উৎস একদিকে যেমন ইউরোপ, এমেরিকান কোম্পানি ( CS grade/ USFDA approved), অপরদিকে ইন্ডিয়ান তৃতীয় শ্রেনীর raw ম্যাটেরিয়াল ও আছে। যে কোম্পানির কাচামাল জার্মানির, তার দাম ও বেশি কাজ ও বেশি, দোকানদারের লাভ কম। আর যার কাচামালের উৎস সে নিজেই জানে না, তার শুধু লাভ আর লাভ কিন্তু কাজের না। আমরা যারা জনপ্রিয় ডাক্তার হইতে চাই, আমরা নামী কোম্পানি ও CS grade কাচামালের ওষুধ কারা বানায় সেইটা খুজে লেখার চেষ্টা করি। এই জন্য আমাদের কাছে আসে প্রথম সারির কোম্পানিগুলো। আর অখ্যাত কোম্পানিগুলো গ্রাম গঞ্জের ফার্মেসির দোকানে যায়, যারা নিজেরাই ডাক্তার সেজে সেই ওষুধ গুলো বিক্রি করতে পারে।
এই দুই নম্বরি এড়ানোর জন্যি আমরা সরাসরি বানিজ্যিক নামে ওষুধ লিখি যেন রুগী সঠিক ওষুধ টা খেতে পারে, ইনফেকশন না হয়, আমার মান টাও বাঁচে।
.
এত টুকু যদি বুঝে থাকেন তো, ছোট্ট একটা কুইজ দিই.....আমাকে বানিজ্যিক নামে স্কয়ার, হেলথকেয়ার, বেক্সিমকোর ওষুধ লিখতে নিষেধ করে দিলেন। আমি Tab- Azithromycin 500 লিখে দিলাম।
রুগী কোন কোম্পানির ওষুধ কিনবে সেইটা পুরোটা ছেড়ে দিলেন ক্লাস এইট পাশ অথবা পড়ুয়া ওষুধের দোকানদারের উপর। সে আপনাকে কোন ওষুধ দিবে?? Tab- Zimax? যেটা বিক্রি করে সে ৫ টাকা লাভ করবে, অথবা আটা ময়দা কোম্পানির ওষুধ, যেটাতে তার লাভ ৩০-৪০ টাকা??
.
স্বাস্থ্য কমিশনের প্রায় সকল সিদ্ধান্তে আমি একমত। ডাক্তারদের চেম্বারে দামী দামী গিফট, স্যাম্পল নিয়ে ভিজিট করা অতিদ্রুত বন্ধ হউক, প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলা বন্ধ হউক। কিন্ত জেনেরিক নামে ওষুধ লেখার মত রাষ্ট্রীয় কাঠামো এখন ও তৈরী হয়নি এদেশে। এদেশের মোড়ে মোড়ে ওষুধের দোকান, মুড়ি মুড়কির মত সেই দোকান থেকে ওষুধ বিক্রি হয়, ফার্মেসীর দোকানদার ও এদেশের ডাক্তার। সেই দেশে দোকানদারের হাতে যদি ওষুধ সিলেক্ট করার ক্ষমতা দেন তো বাঙালাদেশের ভৌগোলিক সীমা থেকে বাঙালি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
এর চেয়ে সরকারি হাসপাতালে সরকারি ফার্মেসী করার ব্যবস্থা করেন। আউটডোর এ ১০০ রুগী দেখা লাগে সেইটার আগে সুরহা করেন। সকল পরীক্ষা নীরিক্ষা মান সম্মত উপায়ে সরকারি হাসপাতালে চালু করেন। মেঝেতে রুগী গড়া গড়ি খাচ্ছে সেইটারে একটা বেড দেন। এগুলো আগে জরুরী।
লেখকঃ
ডা. আব্দুর রব
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)।
আরও পড়ুন