ডা. সাঈদ এনামঃ
নবজাতকের নরম কপালে প্রথম চুমু খেয়ে মা-বাবা চোখের জলে ভাসলেন। সেই মুহূর্তে মায়ের হৃদয় থেকে বেরিয়ে এলো এক ফরিয়াদ, এক অটুট মানত: “হে আল্লাহ, আমার এই ফুলটিকে করে দাও হাফেজে কোরআন।”
আট বছর বয়সে মানত পূরণের তীব্র আশায় ছেলেকে ভর্তি করানো হলো কঠোর নিয়মের এক হিফজখানায়। অদম্য মেধা আর পরিশ্রমে মাত্র দুই বছরে দশ পারা (!) মুখস্থ করে ফেলল সে। মা স্বপ্ন দেখতে লাগলেন—স্বপ্ন সফল হতে আর কতদিন?
কিন্তু হঠাৎ...
নেমে এলো এক বিভীষিকা। যেন কোন অদৃশ্য দানব ছেলেটার সুস্থ মনকে গ্রাস করে নিল! রাতের পর রাত সে ঘুমায় না। খাবার থালা ঠেলে দেয়। একা একা দেয়ালের সাথে কথা বলে, হঠাৎ গমগম করে হাসে, আবার মুহূর্তেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে—যেন ভেতরে লুকিয়ে আছে অদৃশ্য এক যন্ত্রণা। মাদ্রাসায় হাজারো তদবির, রুকইয়া, দোয়া—কিছুতেই থামানো যায় না এই অশরীরী আক্রমণ। মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ হাল ছেড়ে দিলেন, কণ্ঠে অনিশ্চয়তার কাঁপন: “ওকে নিয়ে যান... এখন শুধুই 'ব্রেইনের ডাক্তার'ই পারে কিছু করতে!”
ডাক্তারের চেম্বারে এক করুণ অভিযাত্রা:
২০২৩ সালের এক বিষণ্ন সকাল। হতাশ মা আর বিভ্রান্ত শিশুটি হাজির আমার চেম্বারে। লক্ষণগুলো পরিষ্কার—এটি **সিজোফ্রেনিয়া। নাম শুনেই মায়ের চোখ ছলছল করে উঠল। আমি তার কাঁপতে থাকা হাতটি ধরে বললাম, “ভেঙে পড়বেন না মা। এটা কোনো অভিশাপ নয়, একটা রোগ। সঠিক চিকিৎসা, ধৈর্য আর আল্লাহর রহমতে জয় করা সম্ভব। বিশ্বাস রাখুন!”
শুরু করলাম চিকিৎসা: নিম্নমাত্রার রিসপেরিডন (এন্টিসাইকোটিক) আর পারকিনিল (সাইড ইফেক্ট রোধক)। প্রথম সপ্তাহ... কোন পরিবর্তন নেই। দ্বিতীয় সপ্তাহে ডোজ সামান্য বাড়ালাম। হৃদয়ে এক গোপন আশঙ্কা... কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা।
তারপর... যেন এক অলৌকিক বিস্ময়!
তিন বছর পর...
আমার চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে এক উজ্জ্বল চোখের তরুণ, পাশে এক মহিয়সী নারী—যার চোখে পানি, কিন্তু ঠোঁটে বিজয়ের এক অপূর্ব হাসি। “ডাক্তার সাহেব, চিনতে পারছেন?” মায়ের গলার স্বরে আনন্দের কম্পন। আমি নিবিড়ভাবে তাকালাম তরুণের দিকে। “আমার ছেলে... আপনার সেই রোগী... আজ হাফেজে কোরআন!” কথাগুলো আবেগে পরিপূর্ণ !
বিস্ময়ে হতবাক! মা পুরনো প্রেসক্রিপশনটি বের করলেন। ছেলেটির দিকে তাকালাম আবার—এ সেই শিশু? যে একসময় নিজের ভেতরের শত্রুর সাথে যুদ্ধে প্রায় হার মানতে বসেছিল? যে হিফজের পথে পা রাখতে পারেনি? সে আজ সম্পূর্ণ কোরআন শরীফ হৃদয়ে ধারণ করেছে!
শুধু তাই নয়, তার পাগড়ি পরার দিন ঠিক হয়েছে! তবে সামান্য পুরনো উপসর্গ ফিরে আসায় প্রিন্সিপাল সাহেব জরুরি ভিত্তিতে পাঠিয়েছেন। সে আজও নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছে—কিন্তু তার চোখে এখন আত্মবিশ্বাসের আলো।
মুহূর্তটি স্তব্ধ! আমিও খানিকটা আপ্লুত। হৃদয় ভরে উঠল এক অপরিসীম কৃতজ্ঞতায়—আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীর জন্য, মায়ের অবিচল বিশ্বাসের জন্য, ছেলের অদম্য সাহসের জন্য।
গুরুত্বপূর্ণ বার্তা: আমাদের ভাঙতে হবে কলঙ্কের দেয়াল!
আমাদের সমাজে এখনো মানসিক রোগ = পাগলামি, সমাজচ্যুতি, ব্যর্থ জীবন—এই ভয়াবহ কুসংস্কার গেঁড়ে বসেছে। এই কিশোরের গল্প সেই কুসংস্কারের মুখে এক চপেটাঘাত! সিজোফ্রেনিয়ার মতো জটিল, দুরারোগ্য বলে চিহ্নিত রোগকে জয় করে সে শুধু সুস্থই হয়নি, সে অর্জন করেছে পবিত্র কোরআন হিফজের মতো এক মহান সাফল্য!
ভাবুন তো: হিফজে কোরআনই তো এক বিশাল ইবাদত, এক অলৌকিক স্মৃতিশক্তির নিদর্শন। আর সিজোফ্রেনিয়ার বিভ্রান্তি, ভয়, অস্থিরতার মাঝে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ কোরআন মুখস্থ করা? এ কোন সাধারণ সাফল্য? এ এক মু'জিযা নসীব! সঠিক চিকিৎসা, মায়ের অপরিসীম ধৈর্য ও ভালোবাসা, শিক্ষকদের সহযোগিতা, ছেলের নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তি—এবং সবচেয়ে বড় কথা—আল্লাহর সেই অফুরান রহমত যার কাছে কোন অসুখই অসাধ্য নয়।
শেষ করি এক চাঞ্চল্যকর আরেকটি ঘটনা দিয়ে,
আমেরিকান অর্থনীতিবিদ জন ন্যাশ সিজোফ্রেনিয়া জয় করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন—সেটাও এক বিস্ময়। কিন্তু আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাঙালি কিশোর তার চেয়েও অবিশ্বাস্য এক কীর্তি গড়েছে! সে জয় করেছে কোরআন মুখস্থ করার সর্বোচ্চ সম্মান! সুবহানাল্লাহ!
এই ঘটনা শুধু একটি চিকিৎসা সাফল্যের গল্প নয়। এটি এক জীবন্ত প্রমাণ: মানসিক রোগ জীবনের শেষ কথা নয়! এটি এক নতুন শুরু, এক আলোর পথে যাত্রা। সঠিক চিকিৎসা, সামাজিক সমর্থন এবং ঈমানের শক্তিতে সিজোফ্রেনিয়ার অন্ধকারেও ফুটে উঠতে পারে আলোর কোরআনের ফুল! আল্লাহ যাকে ইচ্ছা, তাকে আশ্চর্য উপায়ে সাহায্য করেন। এই কিশোর হাফেজ তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
লেখকঃ
ডা. সাঈদ এনাম
এমবিবিএস (ডিএমসি), এম ফিল (সাইকিয়াট্রি), বিসিএস (স্বাস্থ্য)
সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি), সিলেট মেডিকেল কলেজ
ফেলো, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।
আরও পড়ুন