ডা. সাঈদ এনামঃ
মাথা ঝিমঝিম করা, কিছুতেই মন না বসা, কারো কথায় খ্যাক খ্যাক করে রেগে ওঠা, অস্থির লাগা, শরীরে জ্বালাপোড়া কিংবা হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া—এসব উপসর্গ অনেক সময় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। কখনও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অকারণ কলহ, শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে সম্পর্কের অবনতি, কিংবা হঠাৎ করেই সংসারে ভাঙনের উপক্রম—এসবও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে।
কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে না গিয়ে, সিলেট অঞ্চলের অনেক সহজ-সরল, অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষ প্রথমেই ছুটে যান এমন এক ভণ্ড পীরের কাছে, যিনি গাছের তলায় বসে থাকেন, বা কোনো কবরের পাশে লাল সামিয়ানা টাঙিয়ে আগরবাতি ও ধূপের ঘন ধোঁয়ার মাঝে ‘জ্বীন তাড়ানোর’ অভিনয় করেন।
অথবা যান সেইসব তান্ত্রিকদের ডেরায়, যাদের গলায় ঝুলে থাকে পশুপাখির অঙ্গ দিয়ে তৈরি অলৌকিক মালা আর যাঁরা গাছ-গাছড়া, ঝাড়ফুঁক আর তাবিজ-কবজের নামে চালিয়ে যান প্রতারণার ব্যবসা।
এরপর যা ঘটে, তা নিছক প্রতারণা নয়—একটি নির্যাতনের চক্র।
এই ভণ্ডরা মানসিক রোগে আক্রান্ত কিশোরী, গৃহবধূ, বিশেষ করে প্রবাসী স্বামীর স্ত্রীদের সহজ টার্গেট বানায়। প্রথমে তারা ‘জ্বীন আছে’, ‘বন্ধন করা হয়েছে’, ‘চোখ লেগেছে’ ইত্যাদি বলে ভয় ধরায়, এরপর শুরু হয় মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক শোষণ। ভিকটিম প্রথমে বোঝেই না তার সঙ্গে কী হচ্ছে। পরে বুঝলেও লোকলজ্জা, পরিবার বা সমাজের ভয়ে কিংবা সংসার ভাঙার ভয়ে চুপ করে যায়।
সিলেট অঞ্চলে এই ভণ্ডপীর, তান্ত্রিক ও ভণ্ড মোল্লাদের দৌরাত্ম্য ভয়াবহ।
তাদের রয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়, আর গ্রামে গ্রামে গড়ে তোলা মুরীদ বা ক্যাডার বাহিনী। এরা মানুষের কানে কানে পৌছে দেয়, “হুজুর ফুঁ দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে”, “হুজুর অন্তর্বাসে ফুঁ দিলে স্বামী বা স্ত্রী ফিরে আসবে”, “হুজুর শুধু মুখ দেখেই সব বলে দিতে পারেন”, "হুজুর ফুঁ দিলে গাড়ি তেল বা পেট্রোল ছাড়া দিনের পর দিন চলে" ইত্যাদি মুখরোচক গালগল্প। এরপর মানত হিসেবে দাবি করা হয় গরু, ছাগল, কিংবা কালো মুরগের বিরিয়ানি।
ভণ্ডদের এই প্রতারণা শুধু অর্থ নয়, নারীদের সম্ভ্রমও কেড়ে নেয়।
বলা হয়, রোগী না পারলে তা পক্ষে না যে কেউ হুজুরের ডেরায় গরু দিয়ে দিতে পারে, তারা গরু জবাই করে ‘গরীব-এতিম’ খাওয়াবে। বাস্তবে এগুলো প্রতারণা।
এভাবে মানতের গরু-ছাগল জমে জমে একদিন গড়ে ওঠে ‘আধ্যাত্মিক খামার’। সে খামার চালান স্বঘোষিত এক ‘ ভন্ডপীর’, যার দুধের ফার্মকে ঘিরে রটে যায় নানান অলৌকিক গুজব—“এই দুধ খেলে যাদু-টোনা কেটে যায়”, “শাশুড়ি-ননদ বশ হয়”, “গৃহস্থালি শান্তি ফিরে আসে”, “পীরের দুধে আছে দেবতুল্য ক্ষমতা”। গ্রামে গ্রামে এসব কথা ছড়িয়ে পড়ে, আর অসহায় মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগীরা ঠকতে থাকে সরল বিশ্বাসে।
ভাগ্যিস, এসব ভণ্ডদের কেরামতি ইউরোপ-আমেরিকা পর্যন্ত ছড়ায়নি! না হলে সেখানকার সরকার রাফায়েল জেট আর এফ-৩৫ স্কোয়াড্রনের প্রটোকল দিয়ে এদের আমদানি করত। ভ্যাটিক্যানের পাশে বানানো হতো একখানা ‘পীর পাড়া’, আর ঝুলিয়ে দিত বিশাল সাইনবোর্ড— “মানসিক রোগের এক নম্বর চিকিৎসক—ফুঁ দিলেই সব রোগ উধাও!” সাথে ‘শিন্নি’ আর ‘গরুর মানত’ হয়তো ঢুকে যেত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রটোকলেও!
পরিশেষে, পবিত্র কোরানে নানান সুরা ও আয়াতে জ্বীনের কথা আছে, শয়তানের কু-মন্ত্রণা আছে সত্য। কিন্তু এই ভণ্ডরা জ্বীন ও ধর্মের নামে মানুষকে টুটকা-তাবীজের ভয় দেখিয়ে প্রতারিত করছে। এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি। মানসিক রোগ হলে সাইকিয়াট্রিস্ট বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিকল্প নয় কোনো ভণ্ড, শয়তানের মুরীদ বা তান্ত্রিক। আপনি সচেতন হলে, সমাজও নিরাপদ হবে।
লেখকঃ
ডা. সাঈদ এনাম
এমবিবিএস (ডিএমসি) এম ফিল (সাইকিয়াট্রি) বিসিএস (স্বাস্থ্য)
সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি)
সিলেট মেডিকেল কলেজ
ফেলো, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।
আরও পড়ুন