Advertisement
Doctor TV

শনিবার, ১০ মে, ২০২৫


শুধিতে হইবে ঋণ

Main Image

ডা. মো. আসাদুজ্জামান (জামান অ্যালেক্স)


১...
 

এ গল্প আপনাদের আগেও বোধ হয় বলেছি। কয়েক বছর আগের ঘটনা। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দ্রুত যেতে হবে। আমার ইউজুয়াল রেগুলার ট্রান্সপোর্ট ঐদিন কোন এক কারণে মিসিং...
 

পাঠাও এ ব্রাউজ করে হোন্ডায় চড়ে বসলাম। যিনি বাইক চালাচ্ছেন, তার মুখে মাস্ক দেয়া। বাইক চলার একটা পর্যায়ে আমি লক্ষ্য করলাম চালক সাহেবের প্যান্টের পকেট থেকে স্টেথোস্কোপ এর মাথা বের হয়ে আসছে। বুঝলাম ডাক্তার সাহেব পার্ট টাইমে বাইক চালিয়ে কিছু ইনকাম করেন। চেম্বারে নাকি রোগীর নিশ্চয়তা নেই, তার তুলনায় বাইকে নাকি রেগুলার যাত্রী পাওয়া যায়...
 

জানলাম ডাক্তার সাহেব ট্রেনিং এ আছেন, ট্রেইনী পিরিয়ডের টাকায় সংসার চলে না। ডেইলী দুয়েকটা বাইকের ক্ষেপ দিলে বাচ্চার দুধের টাকাটা নাকি হয়ে যায়। আমার মনটা উদাস হয়ে গেলো, বাকি পথটা মনটা বিষন্ন হয়ে রইলো...
 

২...
 

আরেক ট্রেইনী ডাক্তারের কথা বলি। ভদ্রমহিলা কোন এক হাসপাতালে একটা ভালো সাবজেক্টে ট্রেনিং করছেন, ৫ বছরের মাঝে ২ বছর ট্রেনিং কমপ্লিট হয়েছে...
 

উক্ত চিকিৎসকের বাসা ঢাকার বাইরে, ঢাকার মাঝে সাবলেট থেকে ট্রেনিং করছেন। ট্রেনিং পিরিয়ডে যে পরিমাণ টাকাটা পান (সেসময় মনে হয় হাজার বিশেক টাকা দেয়া হতো) সেটা সাবলেটের ভাড়ায়, খাবার দাবার আর হসপিটাল ট্রান্সপোর্টে চলে যায়। বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতে হয়। এ টাকার যোগান দিতে উনাকে প্রায় প্রতিদিন মাইল দেড়েক হেঁটে এক বাচ্চাকে পড়াতে যেতে হয়। টিউশনিতে সুবিধা হলো টাকাটা ফিক্সড্ এবং নিশ্চিত। ঐ টাকাটা উনি বাড়িতে পাঠিয়ে দেন...
 

হয়তো অনেকে ভাবছেন, চেম্বার করলেই তো হয়। তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এদেশে কোন রেফারেল সিস্টেম গড়ে না ওঠার না কারণে রোগীদের সাথে চেম্বারে এ টাইপের জুনিয়র শ্রেণীর ডাক্তারদের তেমন কোন কম্যুনিকেশন নাই। রোগীরা চাইলেই বড় অধ্যাপক সাহেবদের দেখাতে পারেন, জুনিয়র ডাক্তাররা থাকেন উপেক্ষিত...
 

৩...
 

এ দুই ঘটনা শুনে যদি আপনার মাঝে প্রশ্ন জাগে যে ডাক্তারদের অবস্থা আসলেই এতো খারাপ? আপনাদের জানাতে চাই যে, অবস্থা আসলে আরো করুণ। আমাদের ডাক্তারদের ক্লোজড্ গ্রুপগুলোতে অনেক ডাক্তারকে যাকাতের টাকা দিয়েও হেল্প করতে হয়।  অবস্থা আসলে এতোটাই নাজুক...
 

দিনকে দিন চিকিৎসকদের অবহেলা করতে করতে আজ জুনিয়র চিকিৎসকরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন যাতে তাদের ভাতা ২৫ হাজার থেকে বাড়ানো হয়...
কল্পনা করতে পারেন? একজন ফুল লোডেড ডাক্তারকে তার সারামাসের পরিশ্রম বাবদ মাস শেষে মাত্র ২৫ হাজার টাকা ধরিয়ে দেয়া হয়! উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির এ সময়ে একজন চিকিৎসক ২৫ হাজার টাকায় কিভাবে তার পরিবার মেনটেইন করবেন! 
 

রাহাত ফতেহ আলী খানকে এক সন্ধারাতের গানের বিনিময়ে ৩ কোটি টাকা দিতে আমাদের টাকার ঘাটতি হয় না, বছরের পর বছর এদেশের মানুষের চিকিৎসা সেবা যারা নিশ্চিত করেন তাদের ভাতা ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার করতে আমাদের যত আপত্তি... হায়রে দুর্ভাগা জাতি!...
 

৪...
 

আমি যে এলাকাটায় থাকি সেটা একটা কসমোপলিটান এরিয়া। বেশীরভাগই ব্যবসায়ী, বেশ কিছু বিদেশীও থাকেন। আমি লক্ষ্য করেছি, এই এরিয়াটায় ডাক্তার হবার কারণে একমাত্র আমিই সকাল থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত সারাদিন গাধারখাটুনি খেটে যাই... 
 

শারীরিক কষ্ট যেমন পাই, তার সাথে মানসিক কষ্ট ও টেনশন তো নিত্যসঙ্গী, কোন্ রোগী মরে গেলো, কোন্ রোগী শকে গেলো, কোন্ রোগীর ব্লিডিং শুরু হলো, কোন্ রোগীর খিঁচুনি শুরু হলো---সারাদিন এসব যন্ত্রণা নিয়েই আছি। ওদিকে আমার এরিয়ার অন্যরা সারাদিন দেখি মাস্তিতে থাকে, অলওয়েজ মুড ইজ ইন চিলড্ কন্ডিশন!...
 

গতকাল রাত ১১ টায় টায়ার্ড হয়ে যখন বাসায় ঢুকছি, প্রতিবেশীরা তখন শীতের আনন্দে ব্যাডমিন্টন খেলছেন। আমি লক্ষ্য করেছি, আমার তুলনায় ১০ গুণ কষ্ট কম করে তারা আমার তুলনায় ১০ গুণ বেশী আর্ন করেন। চিকিৎসকদের সাথে কেন এতো বৈষম্য তা আমার আসলেই অজানা...
 

৫...
 

এদেশে লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে মেগাপ্রজেক্ট হয়, সেখানে মেগা দুর্নীতিও চলে। অথচ জুনিয়র ডাক্তারদের ভাতা ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার করতে আমাদের যত অনীহা!...
 

আমরা বাঙালিরা আসলে জানিই না যে কোথায় আসলে ইনভেস্ট করতে হয়। জানি না বলেই উন্নত চিকিৎসার নামে লক্ষ কোটি টাকা পাশের দেশগুলোতে পাচার হয়ে যায়। অথচ এদেশের স্বাস্থ্য খাতে মেধাবী চিকিৎসক বানাতে যদি লক্ষ কোটি টাকা খরচ  করা হতো, তাদেরকে প্যাট্রোনাইজ করে শুধুমাত্র লেখাপড়ায় এনগেইজ করা যেতো,  তবে দেশের বাইরে থেকেও সেবা নিতে মানুষ এদেশে আসতো...
 

স্বাস্থ্যখাতে দেশের টাকা বাইরে পাচার হওয়া যেমন কমতো, তেমনি বাইরের মানুষ এদেশে চিকিৎসা নিলে এদেশ আয়ও করতে পারতো। আমরা সেটা করতে পারি নাই, আমরা চিকিৎসকদের চাপে রেখে তাদের ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে অন্যান্য নানা কাজে ব্যস্ত রেখেছি। এদের দিয়ে আর যাই হোক, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডের চিকিৎসা আমরা আশা করতে পারি না। এর দায় রাষ্ট্রের, এ লজ্জা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের... 
 

৬...
 

একটা আপডেট দেই। সরকার মহাশয় ট্রেইনী ডাক্তারদের ভাতা বাড়িয়েছেন। যেটা ২৫০০০ টাকা ছিলো, সেটাকে ৩০০০০ হাজার টাকা করা হয়েছে। কামাল কি বাত হ্যয়! পাঁচচচচচ হাজার টাকা বাড়নো হয়েছে!!!
আসেন, আরেকটা খবর আপনাদের দেই। সচিব স্যারদের গাড়ীর রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি মাসে খরচ ৫০০০০ টাকা, আর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মেধাবীদের সারা মাসের খাটুনীর খরচ ৩০০০০ টাকা!!!
 

যে সদাশয় স্যাররা মাত্র ৫০০০ টাকা বাড়িয়ে ভাতা ৩০০০০ টাকা করলেন, সেই স্যাররা তাদের গাড়ীর দেখভালের জন্য মাসে ৫০০০০ টাকা নেন, সেই স্যারদের এইরকম একটা সিদ্ধান্ত এক্সিকিউট করতে  একবারো বিবেকে বাঁধলো না! সব দেশ সামনে এগিয়ে যায়, আমরা কেন পেছনে হাঁটি? 
 

৭...
 

ভারত ও পাকিস্তানে ট্রেইনী ডাক্তারদের ভাতা যেখানে এভারেজ ৬০০০০ রুপী, সেখানে আমাদের দেশে এই ডাক্তারদের আমরা ৩০০০০ টাকা দিতে চাচ্ছি। নিজের দেশের সন্তানকে আমরা এভাবে কেন ঠকাতে চাই?
কাজী নজরুল বলেছিলেন,
"আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্‌ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়ুক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়ুক ঝ’রে..."
 

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ করে বলি, খিল খুলে দিন, নিষ্পেষণের শিকলকে ভেঙ্গে ফেলুন। রাষ্ট্রের সন্তানদের ভাতা বৃদ্ধি করে বেসরকারী ট্রেইনী ডাক্তারদের গায়ে জড়িয়ে থাকা নীল বেদনার চাদরকে সরিয়ে দিন। দেশকে বৈষম্যহীন হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করুন...

 

লেখকঃ 

ডা. মো. আসাদুজ্জামান (জামান অ্যালেক্স)
MBBS (DMC), MRCP (UK), BCS (Health)

আরও পড়ুন