Advertisement
Doctor TV

বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫


চোখের সে ভাষা বুঝতে হলে চোখের মত চোখ থাকা চাই

Main Image

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো


এক.

আজ সকালে এক মা তার ষোড়শী কন্যাকে নিয়ে আমার অফিস-রুমে হাজির হলেন ।

পাশের চেয়ারটি দেখিয়ে বললাম, "এখানে বসুন"।

জিজ্ঞাসু নেত্রে কন্যাকে বললাম, "কী সমস্যা তোমার, বল দেখি"
"সারাটা বুক জ্বলে, অস্থির লাগে, হাত-পা কামড়ায়, ব্যাথা করে, রাতে ঘুম আসে না..." অপ্রতিভ মেয়ের জবাব।

ভাল করে মেয়েটির দিকে তাকালাম। তার চোখ দুটি বড় বড়। চোখের মনিও। ভীতা হরিণীর মত বড় চোখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করছি। যা বুঝার, মুহূর্তের মধ্যেই বুঝে গেলাম। মেয়ের মা'কে বললাম, আপনি একটু বাইরে যান, "আমি আপনার মেয়েকে একাকী কিছু প্রশ্ন করতে চাই"। মেয়ের মা, অনুগত মানুষের মত নিঃশব্দে বাইরে চলে গেলেন।

আমার অফিস রুমের দরজাটা স্বচ্ছ কাঁচের। আব্দুর রহমান আজ সেই কাঁচকে এত সুন্দর করে পরিষ্কার করেছে যে, এখানে আদৌ কোন কাঁচের দরজা আছে কি না ভ্রম হয়। বের হতে গিয়ে আজকে কয়েকজন ঢুশও খেয়েছে।

দরজার ঐ পাশ থেকে মেয়েটির মা আমাদের দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু কোন কথা শুনতে পাচ্ছে না।

মেয়েটিকে বললাম, তোমার বয়স কত?
"ষোল"- সংক্ষিপ্ত জবাব তার।
"কী হয়েছে, খুলে বল"

মেয়েটি আগের মতই বলতে লাগল, "সারাটা বুক জ্বলে, অস্থির লাগে, হাত-পা কামড়ায়, ব্যাথা করে, রাতে ঘুম আসে না......"

আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, "সত্যি কথাটা বল। আমি ডাক্তার। চোখ দেখে মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারি। বল, কোন ছেলে তোমাকে ভালবাসার কথা জানিয়েছে ?"
"না, তেমন কিছু না, সামান্য, খুবই ছোট একটি বিষয়..." এটুকু বলে থেমে গেল মেয়েটি।

আমিও নাছোড়বান্দার মত বললাম "না, এত সামান্য-তে তোমার শরীরের এই অবস্থা হওয়ার কথা নয়। ভাল করে বল, তাহলে তোমার চিকিৎসা করতে সুবিধা হবে। আর, তুমি যদি চাও, তো, তোমার স্কুলের হেড মাস্টার সাহেবকে বলতে পারি তোমাকে সাহায্য করার জন্য"।

"না স্যার, হেডমাস্টার স্যারকে বলার বলার দরকার নেই। আমার বড় বোনই সেই ছেলেকে 'না' করে দিয়েছে। 'সে' (=ছেলেটি) কলেজে পড়ে। আমার স্কুলে যাওয়ার পথে একদিন সে আমাকে ভাল লাগার কথা জানায়। আমারও তাকে ভাল লেগে যায়।"

"তারপর......।"-- জিজ্ঞাসু নেত্রে আমার প্রশ্ন।
"কিন্তু, তিন-চারদিন আগে আমার আপা সে ছেলেকে বারণ করে দিয়েছে" -- তার কণ্ঠে মিনতি, কাউকে যেন আমি না বলি।

মেয়েটির সাথে কথা বলে বুঝলাম, কলেজ পড়ুয়া একটি ছেলে তাকে ভাললাগার কথা জনিয়েছিল। তারপর, দুজনই দুজনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। হঠাৎ করে তার বড় বোন ব্যাপারটি জেনে যায়। তারপর তাকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে সেই ছেলেকে এই সম্পর্ক রাখতে বারণ করে দেয়।

স্বপ্ন-ভাঙ্গা মেয়েটি ডানা-ভাঙ্গা পাখির মত রাতে ছটফট করে। আর দিনের বেলায় তার বুক মরিচের মত জ্বলতে থাকে।

শুরুর দিকে সে কিছু না-বললেও, তার চোখের ভাষা আমাকে এ কথাই বলেছে।

দুই.

পাঁচদিন আগে পঞ্চান্ন বছর বয়স্ক এক ভদ্রলোক এলেন আমার কাছে।
আমার টেবিলের ওপারের চেয়ারে বসলেন তিনি। তারপর নিজ থেকেই শুরু করলেন, "আমার শরীরটা বেশ দুর্বল। শক্তি পাচ্ছি না।"

ভাল করে তাকালাম তার দিকে। খুব ভাল করে। আমার মন কিছু যেন একটা বুঝতে পারল।

"আপনার কি ডায়াবেটিস আছে ?" তার কাছে জানতে চাইলাম।

তিনি বললেন, "হ্যাঁ, আছে; ওষুধও খাচ্ছি সে জন্য"

তার পালস, ব্লাড প্রেসার দেখলাম, হার্ট লাং-য়ে স্টেথোস্কোপ ধরে কিছু একটা ঠাহর করার চেষ্টা করলাম। সবকিছুই সঠিক। কিন্তু আমার সন্দেহ দূর হয় না।

তারপর জিজ্ঞেস করলাম, " আপনার কি বুকে ব্যাথা আছে? বা শ্বাসকষ্ট ?"
"না, কোনটিই নেই"।

পুরুষ মানুষের মনে একবার সন্দেহ ঢুকলে সহজে দূর হয় না। যা ধারণা (=সন্দেহ) করছিলাম, তা নিশ্চিত হতে ভদ্রলোককে পাঠালাম ইসিজি করতে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ইসিজি করে ফিরলেন। Lead 3 এবং aVF-এ ST inversion এবং Pathological Q, দুটোই পাওয়া গেল। মানে, Acute coronary Syndrome (Acute myocardial infarction of inferior surface)।

বুকে ব্যাথার কথা মুখে না-বললেও, তার করুণ চোখের নীরব আর্তনাদ দেখে বুঝেছিলাম, তার ভেতরে প্রচণ্ড একটা ঝড় বয়ে গেছে। সে ঝড় হয়ত তার হৃদপিণ্ডের খানিকটা ভেঙ্গে-চুরে দিয়ে গেছে।

হৃদরোগের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে রেফার করলাম একটি সরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পরে শুনেছিলাম, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার তাকে আমার রেফারেল কাগজ দেখে তৎক্ষণাত ভর্তি করে দিয়েছেন, আর আমার ডায়াগনোসিসকে এপ্রিশিয়েট করেছেন।

তিন.

গতকালের কথা।
অফিস সময় শেষ হওয়ারও বেশ কিছুক্ষণ পর অফিস থেকে বাসায় ফিরছি।
দেখি, প্যান্ট-পরা একজন লোক খালি-গায়ে আউটডোরের সামনে খালি জায়গাটায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম, 'এখান এভাবে শুয়ে আছেন কেন'? লোকটি অস্ফুট স্বরে কী যেন বললেন। কষ্ট করে এর অর্থ উদ্ধার করলে দাঁড়ায়, তার টাকা পয়সা মোবাইল ফোন, সব নিয়ে গেছে।

তার চোখের দিকে তাকালাম। এ চোখ নেশাখোরের চোখ নয়। তার চোখে মোবাইল ফোনের টর্চের আলো ফেললাম। পিউপিলের সাইজ, শেপ, পিউপিলারী রিয়েকশন ভাল করে দেখলাম। যথাযথ রোগ নির্ণয় করতে না-পারলেও তার চোখ দেখে এতটুকু বুঝতে পারলাম, তার উপর স্টুপিফাইয়িং এজেন্ট প্রয়োগ করা হয়েছে।

জরুরী বিভাগে গিয়ে SACMO (=Sub Assistant Community Medical Officer)-কে ডেকে আনলাম। বললাম, এই লোককে হাসপাতালে ভর্তি করে দিন।

SACMO সাহেব বললেন, "স্যার, এ লোক নেশাখোর। উদ্ভ্রান্তের মত, পড়ে যায় যায় অবস্থা, আমার রুমের সামনের বারান্দায় গিয়েছিল। তারপর এখানে এসে ঘুমাচ্ছে। এভাবে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকুক, এমনিতে ঘোর কেটে যাবে।"

আমি বললাম, "নেশাখোর কখনও এত মোটা হয় না। ( =যারা নেশাখোর, তারা খাবার না-কিনে মাদক কিনে। ফলে তারা পুষ্টিহীনতায় ভুগে। সেজন্য তাদের শরীর হয় ক্ষীণকায়)। আর নেশাখোর কখনও এভাবে ঘুমায় না। আপনি নাইটগার্ডকে দিয়ে এই ব্যক্তিকে ওয়ার্ডে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করুন। ওয়ার্ডে নিয়ে তার চিকিৎসা শুরু করা হল।

বিষয়টি প্রায় ভুলেই থাকতাম।
পরেরদিন আড়াইশ' কিলোমিটার দূর থেকে এক ভদ্রলোক আমাকে ফোন করে বললেন, তার এক আত্মীয় কার মাধ্যমে যেন ফোন করে বাড়ীতে খবর দিয়েছেন, তিনি অজ্ঞাত স্থানে পয়জনিং-এর শিকার হয়ে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছেন ।
..............................

তিনটি ঘটনা।
তিনটিই চোখ দিয়ে চোখ দেখা। আমার চোখ দিয়ে অন্যের চোখ দেখা। চোখ দেখেই অন্ত্রের এবং অন্তরের খবর বুঝার চেষ্টা করা।
চোখের সে ভাষা বুঝতে হলে চোখের মত চোখ থাকা চাই। সে চোখের নাম ক্লিনিক্যাল আই।
বয়স বাড়লে এগুলো আপনা থেকেই শার্প হতে থাকে।
..............................
Zainal Abedin Tito
৬ই অক্টোবর, ২০১৭

আরও পড়ুন