Advertisement
Doctor TV

বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫


ডাক্তারদের বিরুদ্ধে প্রচলতি কিছু কথা ও বাস্তবতা

Main Image

ডাক্তারদের বিরুদ্ধে প্রচলতি কিছু কথা ও বাস্তবতা (ইনসেটে লেখক: ডা. রায়হান উল আরেফিন)


'অ্যাড পপুলাম' নামে একটা জনপ্রিয় ফ্যালাসি আছে। এটার মানে হলো জনগণ খুব পছন্দ করে এরকম কোনো কথা প্রচার করা যা আদতে মিথ্যা। এরকম 'পাবলিকে খায়' থিওরি সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো হয় ডাক্তারদের বিরুদ্ধে। দেখে নেয়া যাক ডাক্তারদের বিরুদ্ধে বাজারে চালু এরকম কিছু 'অ্যাড পপুলাম ফ্যালাসি'।

১. ডাক্তাররা জনগণের টাকায় পড়াশোনা করেঃ

আসল তথ্য হলো সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে লাখ লাখ পরিক্ষার্থীদের সাথে ভর্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে মাত্র চার হাজারের মতো ছাত্রছাত্রী প্রতিবছর সরকারের টাকায় ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পায়। বাদবাকি সিংহভাগ যারা ডাক্তারী পড়ে, তারা নিজের বাপের টাকাতেই পড়ে, জনগণের টাকায় না।

আবার সরকারি টাকায় শুধু মেডিকেলে না, একইরকম সরকারি টাকায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পায় ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি, মৎস্য, পশুসহ বিভিন্ন পাবলিক ভার্সিটির হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। সমাজের প্রতি এদের সবার দায়বদ্ধতা ডাক্তারদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

২. পাশ করার পরেই ডাক্তাররা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামায়ঃ

প্রকৃতপক্ষে একজন ডাক্তার পাশ করে বের হতে হতে ২৫ বছর বয়স হয়ে যায়। এরপর পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করতে করতে বয়স হয়ে যায় প্রায় ৩৫ বছর বা আরো বেশি। তারপর চেম্বার প্র‍্যাকটিস শুরু থেকে মোটামুটি জমতে বয়স হয়ে যায় ৪০। এ ২৫-৪০ বছর পর্যন্ত এই পনের বছর এভারেজ ডাক্তারদের ইনকাম থাকে অত্যন্ত নগন্য যা দিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয় প্রতিনিয়ত।

আবার মোটামুটি ভালো প্র‍্যাকটিশনার লেভেল পর্যন্ত আসতে পারে শতকরা দশজনের মতো। অথচ এই বয়সে অন্য প্রফেশনালরা আয় রোজগার করে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

৩. সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যায় নাঃ

প্রতিটা উপজেলা থেকে শুরু করে জেলা, মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে প্রতিদিন বহিঃবিভাগে হাজার হাজার রোগী মাত্র দশটাকার বিনিময়ে সেবা পায়, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ পায়, ঔষধ পায়, ভর্তি থেকে চিকিৎসা পায়, খাবার পায়। প্রতিটা হাসপাতালের ওটিতে প্রতিদিন হাজার হাজার বিভিন্ন জটিল রোগের অপারেশন হয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।

৪. ডাক্তাররা অফিস করেন না, অফিস সময়ে বাইরে রোগী দেখেনঃ

গুটিকয়েক অসাধু ডাক্তার এটা করে থাকলেও বেশিরভাগ ডাক্তারই নিয়মিত অফিস করেন, রোগী দেখেন, ছাত্র পড়ান, অপারেশন করেন, হাসপাতাল পরিচালনা করেন।

অন্যান্য অফিসের মত হাসপাতাল চলেনা। এখানে একজন ডাক্তারের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব থাকে, তাঁকে রোস্টার বা নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই একজন ডাক্তারকে অন্যান্য অফিসের মতো সবসময় একটা নির্ধারিত জায়গায় বা ডেস্কে পাওয়া যায় না।

৫. ডাক্তাররা অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দেনঃ

বিভিন্ন প্যাথলজিকাল, বায়োকেমিক্যাল ও রেডিওলজিকাল টেস্ট কোনো রোগ নির্ণয়ের পূর্বশর্ত। একেক রোগে একেক রকম টেস্ট প্রয়োজন হয়। যেমন শুধু জ্বরের কারণ নির্ধারণ করতেও বহু ধরনের টেস্ট করা লাগতে পারে। কোন টেস্ট প্রয়োজনীয় বা কোনটা অপ্রয়োজনীয় এটা নির্ধারণ করতে পারবেন শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট ডাক্তার। তাই ঢালাওভাবে 'ডাক্তাররা অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করান' এই কথা বলাটা হাস্যকর, খুবই হাস্যকর।

৬. ডাক্তাররা হাসপাতাল থেকে কমিশন খানঃ

রোগীদের টেস্ট বাবদ হাসপাতাল বিল থেকে কমিশন দেয়া হয় এটা সত্য। কিন্তু এই কমিশন খেয়ে থাকে মূলত কোনো রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া আত্মীয় বা বন্ধুবেশী দালালরা। তাদের সাথে হাসপাতালের যোগসাজশ থাকে। রোগির বিলের সাথে সাথে এদের পকেটে নির্ধারিত টাকা ঢুকে যায়। আবার রোগীকে সময় দেয়ার নাম করে রোগীদের কাছ থেকেও এরা হাতিয়ে নেয় প্রচুর টাকা।

কমিশনের সাথে খুবই অল্পসংখ্যক কিছু ডাক্তারও হয়তো জড়িত, কিন্তু সে দায় গণহারে সব ডাক্তারের উপর চাপিয়ে দেয়া চরম বোকামী।

৭. হাসপাতালের যেকোনো অব্যবস্থাপনার দায় ডাক্তারদেরঃ

সম্পূর্ণরুপে ভুল ধারণার একটা হাস্যকর ফ্যালাসি। হাসপাতালে ডাক্তারদের কাজ শুধু চিকিৎসা দেয়া। বাকি দায়িত্ব পালনের জন্য, প্রশাসনিক বডি, নার্স, মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট, ফার্মাসিস্ট, স্টোর কিপার, এমএলএসএস আনসারসহ বিভিন্ন লোকজন আছে। হাসপাতালে কোনো অব্যবস্থাপনা হলেই সব আঙুল ডাক্তারদের দিকে তোলাটা মূর্খতা ছাড়া আর কিছু না।
অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের মতো সরকারি হাসপাতালে কর্মরত সব ডাক্তারই বিসিএস নামক চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরীক্ষা পাশ করেই চাকরিতে জয়েন করে। কিন্তু একই বিসিএসে জয়েন করার পরেও অন্যান্য ক্যাডারের কতো ডাক্তারদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বা সরকারি প্রটোকল না থাকায় ডাক্তাররা সহজেই সবার টার্গেটে পরিণত হয়।

কিছু কিছু ডাক্তার যে কাজে ফাঁকি দেন না বা দায়িত্বে অবহেলা করেন না, তা না। সেটা দেখার, দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি দেয়ার জন্য তাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ আছে, বিএমডিসি আছে। সাথে সমাজের সচেতন মহলও অথেন্টিক কোনো ইভেন্ট নিয়ে মানুষজনকে সচেতন করতে পারেন। গুরুতর কোনো ঘটনার জন্য আইনের আশ্রয় নেয়ার ব্যবস্থা ও আছে।

কিন্তু ডাক্তারদের বিরুদ্ধে এখানে বলা 'অ্যাড পপুলাম' নামক প্রপাগাণ্ডাগুলো কাজে লাগায় বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া এক্টিভিস্ট, তথাকথিত মানবতার ফেরিওয়ালা বা কিছু কিছু হলুদ সাংবাদিক। এদেশের মানুষের আবেগকে পুজি করে সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে এরা ডাক্তারদের বিরুদ্ধে একধরনের শ্রেণি ঘৃণা তৈরিতে, মব জাস্টিসের মতো ঘৃণ্য অপরাধকে উস্কে দিতে সদা সচেষ্ট।

মনে রাখবেন আপনার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আপনার স্বাস্থ্যের যেকোনো ধরনের সমস্যায় ডাক্তাররাই আপনাদের পাশে থাকবে; এসব স্বস্তা জনপ্রিয়তালোভী সুবিধাবাদী মহল না।

এদেরকে বয়কট করুন।

আরও পড়ুন