কুষ্ঠমুক্ত হোক আমাদের বাংলাদেশ- লিখেছেন : ডা. নায়েব আলী
কুষ্ঠরোগ : মানব ইতিহাসের প্রাচীন রোগগুলোর একটি হলো কুষ্ঠরোগ। এটি একটি সংক্রামক রোগ- যা মানুষের চামড়া মিউকাস, মেমব্রেন ও প্রান্তীয় স্নায়ুগুলোকে আক্রমন করে। কুষ্ঠরোগ মাইক্রো ব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি (M.leprae) নামক জীবাণু দিয়ে হয়।
সুপ্তিকাল : কুষ্ঠরোগের জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশের পর রোগের লক্ষণ সাধারণত: ৫ বছর সময় লাগে। কখনো কখনো ২০ বছর সময় পর্যন্তও লাগতে পারে।
কিভাবে ছড়ায় : আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে এলে কুষ্ঠরোগের জীবাণু চামড়া ও শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এই জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়।
কুষ্ঠরোগের লক্ষণ : আক্রান্ত চামড়ায়/ত্বকে কিছুটা লালচে রংয়ের অথবা হাইপোপিগমেন্টটেড লেশন, আক্রান্ত স্থানে অনুভূতি শূণ্যতা তৈরি হয় অথবা আক্রান্ত হাত-পায়ের দুর্বলতা বা অসাড়তা থাকতে পারে। প্রান্তীয় স্নায়ু মোটা ও ব্যথা হতে পারে।
রোগ নির্ণয় : রোগের লক্ষণ দেখে, শারিরীকভাবে পরীক্ষা করে, কিছু রুটিন পরীক্ষা করতে হয়। কিছু স্পেসিফিক পরীক্ষা- যেমন : স্কিন বায়োপসি, স্লিট স্কিন, স্মিয়ার, পিসিআর ইত্যাদি টেস্ট করে কুষ্ঠরোগ নির্ণয় করা হয়।
চিকিৎসা : প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হলে কুষ্ঠরোগ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী, Paucibacillary Type হলে ৬ মাস ব্যাপী, Multibacillary Type হলে ১২ মাস ব্যাপী চিকিৎসা করা হয়। এক্ষেত্রে অনুমোদিত মাল্টিড্রাগ রেজিমেন ব্যবহৃত হয়। যক্ষ্মারোগের ন্যায় সরকারিভাবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে কুষ্ঠরোগের ওষুধ দেয়া হয়।
কুষ্ঠরোগের জটিলতা : প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের চিকিৎসা নিলে সাধারণত: জটিলতা হয় না। কিন্তু সময়মত চিকিৎসা না করালে অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন আক্রান্ত হাত-পায়ের দুর্বলতা, অসাড়তা, কখনো কখনো অঙ্গহানীও হতে পারে। ফলে রোগী কর্মদক্ষতা হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারেন।
কুষ্ঠরোগী সামাজিক নিগ্রহের স্বীকার হয়ঃ
সমাজের মানুষ কুষ্ঠরোগীকে অবজ্ঞা-অবহেলা করে। ফলে শারীরিক যন্ত্রণার চেয়ে মানসিক যাতনা কুষ্ঠরোগীকে বেশি কষ্ট দেয়।
বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগের অবস্থাঃ
কুষ্ঠ ভারাক্রান্ত দেশ হিসেবে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ।
২০২১ সালে দেশে কুষ্ঠরোগী ছিল ২ হাজার ৮শ’ ৭২ জন। কুষ্ঠজনিত শারীরিক প্রতিবন্ধী হয় ১৬৫ জন।
২০২০সালে কুষ্ঠরোগী ছিল ২ হাজার ৭শ’ ২৪ জন। কুষ্ঠজনিত শারীরিক প্রতিবন্ধী হয় ১৩৭ জন।
২০১৯ সালে কুষ্ঠরোগী ছিল ৩ হাজার ৬শ’ ৩৮ জন। কুষ্ঠজনিত শারীরিক প্রতিবন্ধী হয় ২৫২ জন।
দেশের উত্তরবঙ্গের ৬টি জেলায় সবচেয়ে বেশি কুষ্ঠরোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। জেলাগুলো হলো- রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও পঞ্চগড়। এছাড়াও মেহেরপুর, মৌলভীবাজার ও জয়পুরহাটেও অনেক কুষ্ঠরোগী পাওয়া গেছে।
সারাদেশে কুষ্ঠরোগ নির্মূল কর্মসূচি চলমান রয়েছে। দেশে The Laprosy mission International সহ ৮টি এনজিও এই কর্মসূচিতে সরকারকে সহায়তা করছে। দেশে ৩টি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে কুষ্ঠরোগের জন্য।
২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে কুষ্ঠমুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরআগে, কুষ্ঠ নির্মূলের পদক্ষেপ হিসেবে ২০০০ সালের মধ্যে প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যায় ১ জনের নিচে কুষ্ঠরোগীর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ১৯৯৮ সালের মধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।
প্রতিকারঃ
এই রোগের কোন টিকা নাই। জনগণের মধ্যে কুসংস্কার দূর করে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য-শিক্ষা প্রদান, কুষ্ঠ নির্মূল কর্মসূচির লোকবল ঘাটতি পূরণ, স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান- ইত্যাদি নানাবিধ পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশকে কুষ্ঠমুক্ত করতে হবে।
লেখক : ডা. নায়েব আলী
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), ডিভিডি (চর্ম ও যৌন রোগ)
সহকারী রেজিস্ট্রার, কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ।
আরও পড়ুন