
ছবিঃ সংগৃহীত
প্রতিদিনের জীবনে আমরা যতটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করি না কেন, বাংলাদেশের মতো গরম ও ঘনবসতি পূর্ণ দেশে টাইফয়েডের ঝুঁকি থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা প্রায় অসম্ভব। দূষিত পানি, খাবার, কিংবা অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন সব মিলিয়ে এই ব্যাকটেরিয়া জনিত জ্বর এখনো একটিবড় জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। তাই এখন সময় এসেছে সচেতন হওয়ার, এবং নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে টাইফয়েড ভ্যাক্সিন গ্রহণের গুরুত্ব বোঝার।
টাইফয়েড: এক নীরব ঘাতক
টাইফয়েড বা “পায়খানা জ্বর” হয় Salmonella enterica serotype Typhi নামের এক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে। এটি সাধারণত দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। শুরুতে জ্বর, দুর্বলতা, মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা এই উপসর্গ গুলো কে অনেকেই সাধারণ সর্দি-জ্বর ভেবে অবহেলা করেন। কিন্তু সময় মতো চিকিৎসা না পেলে এই ব্যাকটেরিয়া রক্তে ছড়িয়ে ফেলে অন্ত্র ফেটে যাওয়া, রক্তক্ষরণ বা এমনকি মৃত্যু ও ঘটাতে পারে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্যমতে, প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৯ মিলিয়ন মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ১ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তানও ভারতের মতো দেশে রোগটি সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত।
কেন ভ্যাক্সিন নেওয়া জরুরি
রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়
টাইফয়েড প্রতিরোধের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে ভ্যাক্সিন। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (immune system) সক্রিয় করে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, টাইফয়েড ভ্যাক্সিন গ্রহণ করলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
মারাত্মক জটিলতা থেকে সুরক্ষা
চিকিৎসানা পেলে টাইফয়েডে অন্ত্রফেটে যেতে পারে, যাজীবন হানির কারণ। ভ্যাক্সিন এই জটিলতা গুলো অনেকাংশে প্রতিরোধ করে এবং রোগ হলে তার তীব্রতা কমিয়ে দেয়।
অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ মোকাবিলা
বর্তমানে টাইফয়েড সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া বহু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ফলে চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ছে। ভ্যাক্সিন নেওয়ার ফলে সংক্রমণের হার কমবে এবং ওষুধের ওপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে যা “Antimicrobial Resistance” মোকাবিলায় বড় ভূমিকা রাখে।
পরিবারও অর্থনীতির সুরক্ষা
একজন টাইফয়েড রোগীর চিকিৎসা খরচ, কর্মঘণ্টা ক্ষতিও পরিবারের মানসিক চাপ সব মিলিয়ে এটি অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্যাক্সিনপ্রয়োগ করলে এই খরচকমে যায় এবং দেশ ব্যাপী এটি “কস্ট-সেভিং” (ব্যয়-সাশ্রয়ী) কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে।
ভ্যাক্সিনের ধরন ও কার্যকারিতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বর্তমানে তিন ধরনের টাইফয়েডভ্যাক্সিন অনুমোদন দিয়েছে:
এই তিনটির মধ্যে TCV সবচেয়ে কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধদেয় বলে WHO ২০১৮ সালে এটিকেপ্রাধান্য দেওয়ার সুপারিশ করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশেপ্রতি বছর লাখো মানুষটাইফয়েডে আক্রান্ত হয়, যার একটিবড় অংশ শিশু। এইবাস্তবতায় সরকার ২০২৫ সাল থেকে জাতীয় টাইফয়েড ভ্যাক্সিনেশন কর্মসূচি শুরু করেছে। এতে৯ মাস থেকে ১৫বছর বয়সী প্রায় ৫ কোটি শিশু বিনামূল্যে টিকা পাবে।
ইপিআই (Expanded Programme on Immunization) প্রোগ্রামের আওতায় এই টিকাটি যুক্ত করা হচ্ছে, যাতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরাও সহজে সুরক্ষা পায়।
ঢাকায় পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, TCV ভ্যাক্সিন নেওয়া শিশুদের মধ্যে টাইফয়েডের ঝুঁকি ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।
ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরও পরিষ্কার পানি, নিরাপদ খাবার ও ভালো স্যানিটেশনের অভ্যাস বজায় রাখা জরুরি। কারণ ভ্যাক্সিন শুধুমাত্র টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করে, কিন্তু অন্যান্য ডায়রিয়া বা প্যারাটাইফয়েডের ঝুঁকি থেকে রক্ষা দেয় না। এছাড়া, সময়ের সঙ্গে সুরক্ষা কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হতে পারে।
টাইফয়েড প্রতিরোধ করা সম্ভব শুধু একটি টিকা নিতে হবে, সময় মতো। এটি শুধু ব্যক্তিকে নয়, গোটা সমাজকে রোগও অর্থনৈতিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবে। বাংলাদেশে এই ভ্যাক্সিন এখন সরকারিভাবে বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে এ সুযোগ হাত ছাড়া না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। একটি ছোট ইনজেকশনই পারে বড় বিপদ ঠেকাতে।
আরও পড়ুন