ছবিঃ সংগৃহীত
গাজায় খাদ্য সংকট ও অপুষ্টিতে আরও ১৪ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে দুই শিশু। সোমবার (স্থানীয় সময়) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যে বলা হয়, ইসরায়েল গত অক্টোবর থেকে হামলা শুরু করার পর এই পর্যন্ত অপুষ্টিজনিত কারণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৭ জনে, যাদের মধ্যে ৮৮ জনই শিশু।
সম্প্রতি এই মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। গাজা বর্তমানে চরম খাদ্য সংকটে আছে, যার অন্যতম কারণ হলো ইসরায়েলের কঠোর অবরোধ ও মানবিক সহায়তা সরবরাহে বাধা।
চলতি বছরের মার্চে ইসরায়েল গাজায় পূর্ণাঙ্গ অবরোধ আরোপ করে, যা মে মাসে আংশিকভাবে শিথিল হয়। এরপর থেকে সীমিত সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলেও তা গাজাবাসীর প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা।
এদিকে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ত্রাণ সংস্থা UNRWA–এর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি জানিয়েছেন, গাজায় অবস্থানরত তার সহকর্মীরা বর্তমান পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছেন “জীবিত নয়, মৃতও নয়—হাঁটছে কেবল, যেন জীবন্ত মৃতদেহ” হিসেবে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের এক সম্মেলনে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে কেবল নিন্দা নয়, প্রয়োজন তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি, দুর্ভিক্ষ নিরসন এবং মানবিক সহায়তার প্রবাহ নিশ্চিত করা।”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্কটল্যান্ড সফরের সময় বলেন, “গাজায় বহু মানুষ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদের বাঁচানো সম্ভব, কিন্তু দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন।” তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে কোনো ধরনের সীমা ছাড়া খাদ্য সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করবে, যেখানে সবার প্রবেশাধিকার থাকবে। তার ভাষায়, “বাস্তবিকই দুর্ভিক্ষ চলছে, আর এর জন্য ইসরায়েলের অনেকখানি দায় আছে।”
তবে এ বিষয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। রবিবার তিনি বলেন, “গাজায় কোনো দুর্ভিক্ষ নেই” এবং হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তবে পরদিন এক্স-এ দেওয়া এক বার্তায় নেতানিয়াহু বলেন, “পরিস্থিতি কঠিন” এবং ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলে মানবিক সহায়তা প্রবাহ অব্যাহত রাখতে কাজ করছে।
ইসরায়েলের ঘোষণা অনুযায়ী, তারা কিছু এলাকায় সাময়িকভাবে হামলা বন্ধ রাখবে এবং নতুন করিডোর চালু করবে যাতে করে সহায়তা পৌঁছানো সহজ হয়। তবে আল জাজিরার প্রতিবেদক তারেক আবু আজ্জুম জানাচ্ছেন, এসব 'হিউম্যানিটারিয়ান পজ' বা মানবিক বিরতি আসলে ইসরায়েলের একতরফা সিদ্ধান্ত, যা কয়েক ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয় না এবং কোনো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ছাড়াই চলে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪ জন অপুষ্টিতে মারা গেছেন। আল-শিফা হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, খাদ্যের ঘাটতির কারণে শিশু মুহাম্মদ ইব্রাহিম আদাস মারা গেছে, কারণ গাজায় কয়েক মাস ধরেই শিশু খাদ্যের তীব্র সংকট চলছে।
গাজার সরকারি গণমাধ্যম অফিস জানায়, “১৫০ দিন ধরে শিশু খাদ্য প্রবেশে বাধা থাকায় প্রায় ৪০ হাজার এক বছরের নিচের শিশু ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।” সংস্থাটি অবিলম্বে সব সীমান্ত খুলে দেওয়ার এবং জরুরি ভিত্তিতে শিশু খাদ্যসহ মানবিক সহায়তা প্রবেশের আহ্বান জানায়।
সোমবার কিছু ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করলেও স্থানীয়রা তাতে হামলে পড়ে খাদ্য তুলে নেয়। আল জাজিরার হিন্দ খুদারি বলেন, “তারা জানায়, তাদের কোনো সময় নেই অপেক্ষার। শিশুদের না খেয়ে দিন কাটছে। ফলে একমাত্র উপায় ছিল ট্রাকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া।”
জাতিসংঘ ইসরায়েলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও সংস্থার মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার বলেন, “এই সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় এক ফোঁটা পানির মতো। আমরা এখনো আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে অবাধ প্রবেশের অবস্থায় পৌঁছাতে পারিনি। নিরাপত্তা হুমকি, সীমান্ত বন্ধ, ভিসা জটিলতা ও শুল্ক সমস্যা আমাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে।”
এদিকে, গাজার বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত রয়েছে। সোমবার অন্তত ৮৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৪০ জন ছিলেন খাদ্য সহায়তা নিতে আসা মানুষ। আল জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF) কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের আশেপাশে অন্তত ১,০০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
এই ফাউন্ডেশনটি মার্কিন ও ইসরায়েলি সহায়তায় পরিচালিত হলেও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমালোচনার মুখে পড়েছে। অভিযোগ, ফাউন্ডেশনটি পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে ব্যর্থ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অত্যন্ত দুর্বল।
ক্রমাগত এ ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে বিশ্বজুড়ে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও সহায়তা পৌঁছানোর দাবি আরও জোরালো হচ্ছে।
আরও পড়ুন