ডা. মোহাম্মদ সাঈদ এনামঃ
প্রতিটি মানুষের শরীর যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি তার মনও একেবারে স্বতন্ত্র। কেউ ছোট একটি ঘটনায়ও খুব কষ্ট পান, আবার কেউ শান্তভাবে তা সামলে নেন। কেউ কোনো বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেন, আবার কেউ একই বিষয়ে থাকেন উদাসীন। মনের প্রতিক্রিয়ার এই বৈচিত্র্যের কারণে সবাইকে একক কোন মানসিক রোগে একই ধরনের ওষুধ দিয়ে একই রকম ফল পাওয়া সবসময় সম্ভব হয় না—এবং এখানেই পার্সোনালাইজড সাইকিয়াট্রির প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে।
পার্সোনালাইজড সাইকিয়াট্রি কি?
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে এটি এমন এক আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি, যেখানে রোগ একটি হলেও চিকিৎসা হবে ব্যক্তি বিশেষ অনুযায়ী। যেমন ধরুন, ডিপ্রেশন বা সিজোফ্রেনিয়া—এ ধরনের মানসিক রোগের জন্য বহু ধরনের ওষুধ রয়েছে। কিন্তু কোন রোগীর ক্ষেত্রে কোন ওষুধটি সবচেয়ে ভালো কাজ করবে—সেটা নির্ভুলভাবে বেছে নেওয়াই হলো পার্সোনালাইজড সাইকিয়াট্রির মূল লক্ষ্য।
কিভাবে উপযোগী ওষুধ বেছে নেওয়া হয়?
এই পদ্ধতি কয়েকটি ধাপে কাজ করে। প্রথমে রোগীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইতিহাস, জীবনযাত্রা, স্ট্রেস ফ্যাক্টর এবং পূর্ব চিকিৎসার প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর ফার্মাকোজেনোমিক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে বোঝা হয়, রোগীর জিন ওষুধকে কীভাবে মেটাবলাইজ করে (যেমন: CYP450 এনজাইম সিস্টেমের মাধ্যমে) এবং শরীর নির্দিষ্ট রিসেপ্টরের প্রতি কেমন সাড়া দেয়।
এছাড়া, বায়োমার্কার বিশ্লেষণের মাধ্যমে যেমন ইনফ্লামেটরি সাইটোকাইন (যেমন IL-6, TNF-α), কর্টিসল বা অন্যান্য হরমোনের মাত্রা, এবং নিউরোট্রফিন (যেমন BDNF) মূল্যায়ন করে রোগীর মানসিক অবস্থার জৈবিক প্রোফাইল নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। এই জৈবিক সূচকগুলো রোগ নির্ণয়, রোগের গতি ও ওষুধের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আগাম ধারণা দিতে পারে। ফলে চিকিৎসা পরিকল্পনায় রোগীভিত্তিক সুনির্দিষ্ট ওষুধ বেছে নিতে এই বায়োমার্কার অ্যানালাইসিস কার্যকর সহায়ক ভূমিকা রাখে।
এরপর, চূড়ান্তভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগীর জিনতাত্ত্বিক ও ক্লিনিক্যাল তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য ড্রাগ রেসপন্স ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়, এবং চিকিৎসা পরিকল্পনা আরও নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করা যায়। চিকিৎসা শুরুর পর, রোগীর সাড়া অনুযায়ী প্রয়োজন হলে ওষুধ বা ডোজে পরিবর্তন আনা হয়।
একটু উদাহরণ দেই
ধরুন, দুই বন্ধুরই মন খারাপ থাকে। একজনের মন খারাপ তার পারিবারিক সমস্যার কারণে, আরেকজনের মন খারাপ পরীক্ষা নিয়ে ভয়ে। এখন দুইজনকে মন খারাপের একই ধরনের ওষুধ দিলে হয়তো একজন উপকৃত হতে পারেন, কিন্তু অন্যজনের ক্ষেত্রে আশানুরূপ উন্নতি নাও হতে পারে।
আবার ধরুন, একজন সিজোফ্রেনিয়ার রোগী মাত্র ১০ মিগ্রাম অলানজাপিনেই ভালো আছেন, অথচ তিনি রিসপেরিডনের সর্বোচ্চ মাত্রা ১৬ মিগ্রামেও উন্নতি পাননি। অপরদিকে, আরেকজন রোগী মাত্র ২ মিগ্রাম রিসপেরিডনেই ভালো আছেন, কিন্তু অলানজাপিনের সর্বোচ্চ মাত্রা ২০ মিগ্রামেও কোনো উপকার পাননি।
এই ড্রাগ রেসপন্সের ভিন্নতাগুলো এখন আমরা মূলত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বুঝি, বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে পাই। কিন্তু পার্সোনালাইজড সাইকিয়াট্রি ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিকাশের ফলে ভবিষ্যতে চিকিৎসার শুরুতেই নির্ভুলভাবে জানা যাবে—কার জন্য কোন ওষুধ সবচেয়ে উপযোগী।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে
পার্সোনালাইজড সাইকিয়াট্রি চিকিৎসা পদ্ধতি বর্তমানে উন্নত বিশ্বের অল্প কিছু গবেষণাকেন্দ্র ও বিশেষায়িত ক্লিনিকে সীমাবদ্ধ। এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন হয় ব্যয়বহুল প্রযুক্তি, জিনগত বিশ্লেষণ এবং অত্যন্ত প্রশিক্ষিত জনবল। আমাদের দেশে এখনো তা বাস্তব রূপ না পেলেও, ভবিষ্যতে—হয়তো ২০, ৫০ কিংবা ১০০ বছর পর—আমরাও পারবো মানসিক রোগের এমন নিখুঁত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসা চালু করতে। সেই আশাই হোক আমাদের আগামী দিনের অনুপ্রেরণা।
ডা. মোহাম্মদ সাঈদ এনাম
সহযোগী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি বিভাগ, সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ।
আরও পড়ুন