Advertisement
Doctor TV

বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫


দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশ ক্যান্সারের রোগী: বিএসএমএমইউর গবেষণা

Main Image

শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশে ক্যান্সারের বোঝা: জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি শীর্ষক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠান


বাংলাদেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বৃহত্তর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে- দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশ ক্যান্সারের রোগী। দেশে প্রতি লাখে ক্যান্সারের আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০৬। প্রতি বছর নতুন করে আক্রান্ত হন প্রতি লাখে ৫৩ জন। ৩৮ ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালী এবং জরায়ু মুখের ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বেশি। 

 

শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশে ক্যান্সারের বোঝা: জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি শীর্ষক এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। 

 

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মোঃ আবুল কালাম আজাদ, উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মোঃ মুজিবুর রহমান হাওলাদার, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর  অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের  চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোঃ আতিকুল হক।

 

অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, নিত্যনতুন জ্ঞান তৈরিতে গবেষণার বিকল্প নাই। বিএসএমএমইউ থেকে সেই গবেষণায় পরিচালনা করা উচিত যা রোগীদের কল্যাণে কাজে আসে। যেসকল গবেষণা দেশের মানুষের, দেশের রোগীদের উপকার হবে সেক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা অব্যাহত থাকবে।

 

ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, গণআকাঙ্খা পূরণ করে এমন গবেষণার জন্য ফান্ডের কোনো সমস্যা হবে না। বিএসএমএমইউর উদ্যোগে পরিচালিত বাংলাদেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি থেকে যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে তা দেশের মানুষের ক্যান্সার প্রতিরোধ, প্রতিকার ও ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় বিরাট ভূমিকা রাখবে। একই সাথে এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশে ক্যান্সার নিয়ে গবেষণার বহুমুখী দ্বার উন্মোচন করেছে।

 

প্রধান গবেষক পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান জানান, ক্যান্সার বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি। বাংলাদেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি  বা নিবন্ধন (পিবিসিআর) না থাকায় প্রতিবেশী দেশগুলোর তথ্য ব্যবহার করে ক্যান্সারের পরিস্থিতি অনুমান করতে হয়। এর ফলে বাংলাদেশে ক্যান্সারের সঠিক পরিস্থিতি জানার ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আছে। তাই জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বা বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্যান্সারের পরিস্থিতি নির্ণয় করা জরুরি হয়ে পড়েছিল, এজন্যই এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়। তিনি জানান, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। এই গবেষণায় প্রতিটি বাড়িতে বিশেষভাবে তৈরি করা ইন্টারনেট ভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন সফটওয়্যার করে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহণ করা হয়েছে। এক বছর পূর্তিতে একই পরিবারের ফলোআপ পরিদর্শন ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়েছে।  

 

ড. মো. খালেকুজ্জামান জানান, ২ লক্ষ মানুষের উপর এই গবেষণা পরিচালন করা হয়। বাংলাদেশে ৩৮ ধরনের ক্যান্সারের রোগী পাওয়া গেছে। প্রতি লাখে ১০৬ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। ৯৩ শতাংশ রোগীর বয়স ১৮ থেকে ৭৫ বছর। ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ২.৪ শতাংশ শিশুরা রয়েছে। ৫.১ শতাংশ রোগীর বয়স ৭৫ বছরের বেশি। ৫টি প্রধান ক্যান্সার হল স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালী এবং জরায়ু মুখের ক্যান্সার। পুরুষদের ৫টি প্রধান ক্যান্সার হল শ্বাসনালী, পাকস্থলী, ফুসফুস, মুখ ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার। নারীদের ৫টি প্রধান ক্যান্সার হল স্তন, জরায়ুমুখ, মুখ, থাইরয়েড এবং ওভারি। পুরুষ ক্যান্সার রোগীদের ৭৫.৮ শতাংশ ধূমপায়ী এবং ধোঁয়াহীন পান, জর্দ্দা, তামাক সেবনকারী ৪০.৫ শতাংশ। ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ৬০.৬ শতাংশ নারী ধোঁয়াহীন পান, জর্দ্দা, তামাক সেবনকারী। ৪৬ শতাংশ রোগীর ক্যান্সারের সাথেই তামাক সেবনের সম্পর্ক রয়েছে। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ কমবাইন্ড চিকিৎসা নিয়েছে এবং ৭.৪ শতাংশ রোগী কোনো চিকিৎসাই নেয়নি। দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী। মৃত রোগীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফুসফুস, শ্বাসনালী ও পাকস্থলীর ক্যান্সার। প্রতি বছর নতুন করে প্রতি লাখে ৫৩ জন রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ফুসফুস, লিভার ও শ্বাসনালীর ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা বেশি।

 

গবেষণার ফলাফল: প্রাথমিকভাবে ২০১,৬৬৮ জন অংশগ্রহণকারী ৪৬,৬৩১টি পরিবারের মধ্যে থেকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হন, যার মধ্যে ৪৮.৪% পুরুষ এবং ৫১.৬% নারী। মোট ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ছিল ২১৪ এবং ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব ছিল প্রতি ১,০০,০০০ জনে ১০৬ (পুরুষদের জন্য, প্রতি ১,০০,০০০-এ ১১৮ এবং নারীদের জন্য, প্রতি ১,০০,০০০-এ ৯৬)।  গবেষণা জনসংখ্যা ৩৮টি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে চিহ্নিত হয়েছে। ৯২.৫% ক্যান্সার রোগী ১৮-৭৫ বছর বয়সী। ১৮ বছরের নিচে ২.৪% এবং ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৫.১% ছিলেন। সর্বোচ্চ ৫টি ক্যান্সার ছিল: স্তন (১৬.৮%), ঠোঁট, মৌখিক গহ্বর (৮.৪%), পেট (৭.০%), গলা (৭.০%) এবং জরায়ু (৫.১%)। পুরুষদের মধ্যে, গলার ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল (১৩.০%)। অন্যান্য প্রধান ক্যান্সার ছিল পেট (১০.৪%), ফুসফুস (৮.৭%), ঠোঁট ও মৌখিক গহ্বর (৭.০%) এবং খাদ্যনালী (৬.১%)। নারীদের মধ্যে, স্তন ক্যান্সার ছিল সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সার (৩৬.৪%)। এছাড়া, জরায়ুর ক্যান্সার (১১.১%), ঠোঁট ও মৌখিক গহ্বরের ক্যান্সার (১০.১%), থাইরয়েড (৭.১%) এবং ডিম্বাশয় (৫.১%) অন্যান্য প্রধান ক্যান্সার ছিল। ১৯% মহিলা ক্যান্সার রোগী নারী প্রজনন সিস্টেমের ক্যান্সারে আক্রান্ত (জরায়ু ১১%, ডিম্বাশয় ৫%, এবং জরায়ু ৩%)। ক্যান্সার রোগীদের সহ-রোগের মধ্যে ছিল উচ্চ রক্তচাপ (১৭%), ডায়াবেটিস (১১%), হৃদরোগ (৬%), দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ (৩%), এবং স্ট্রোক (২%)। ৭৫.৮% পুরুষ ক্যান্সার রোগী ছিলেন ধূমপায়ী। ৪০.৫% পুরুষ এবং ৬০.৬% নারী তামাকবিহীন সেবন করতেন। সর্বমোট ক্যান্সারের ৪৬% তামাক (ধূমপান ও তামাকবিহীন) সেবনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। ৬০% ক্যান্সার রোগী সার্জারি, কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপির সংমিশ্রণ চিকিৎসা পেয়েছিলেন। ৭.৪% রোগীকে কোনো চিকিৎসা প্রদান করা হয়নি।

 

ফলোআপ: ১ জুলাই ২০২৪ থেকে ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ১৩,৪১১টি পরিবারের ৫৮,৫৩৯ জন অংশগ্রহণকারীর ফলোআপ করা হয়েছিল। এক বছরে নতুন ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা যুক্ত হয়েছে প্রতি ১,০০,০০০ জনে ৫২.৯। নতুন সংযোজিত ৩টি প্রধান ক্যান্সার ছিল: ফুসফুস (১৬.১%), যকৃত (১২.৯%), এবং গলা (১২.৯%)। পুরুষদের জন্য, নতুন সংযোজিত ক্যান্সারের মধ্যে ৩টি প্রধান ক্যান্সার হলো ফুসফুস (১৬.১%), যকৃত (১২.৯%), এবং স্বরযন্ত্রের ক্যান্সার (১২.৯%)। নারীদের নতুন সংযোজিত ক্যান্সার হলো লিভার (যকৃত) (২৩.১%), জরায়ুর ক্যান্সার (১৫.৪%) এবং খাদ্যনালীর ক্যান্সার (১৫.৪%)। মোট মৃত্যুর মধ্যে ক্যান্সারে মৃত্যুর কারণ হলো ১১.৯% বা প্রায় ১২ শতাংশ। ক্যান্সারে মৃত রোগীদের মধ্যে ছিল ফুসফুসে ক্যান্সার (১১.৪%), স্বরযন্ত্র (গলা) ক্যান্সার (৮.৫%) এবং পেট ক্যান্সার (৫.৭%)। পুরুষদের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান ২টি ক্যান্সার হলো ফুসফুস (১৯.০%) এবং স্বরযন্ত্র (গলা) (১৪.৩%) এবং নারীদের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান কারণ স্তন ক্যান্সার (১৪.৩%) এবং পেট ক্যান্সার (১৪.৩%)।

 

অনুষ্ঠানে বর্তমান জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি স্থায়ী করার জন্য এই জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধনটি সচল রাখতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, গবেষকদের বর্তমান রেজিস্ট্রি ব্যবহার করে ভবিষ্যতে ক্যান্সার গবেষণা পরিচালনা করতে উৎসাহিত করার সুপারিশ করা হয়। এই গবেষণায় অর্থায়ন করে এনসিডিসি, ডিজিএইচএস এবং বিএসএমএমইউ।

আরও পড়ুন