Advertisement
Doctor TV

বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫


যেমন দেখেছি কোরিয়ার রেসিডেন্ট/পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেইনি

Main Image

কোরিয়ার রেসিডেন্ট/পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেইনি (ইনসেটে ডা. মুহিব্বুর রহমান রাফে)


আমাদের দেশের মতো সবজায়গাতেই পোস্ট গ্রাজুয়েট রেসিডেন্ট আছে। একেবারে ফুল টাইম।

কোরিয়াতে মেডিকেল রেসিডেন্সী চার বছর। এই ফাঁকে ওদের এডুকেশন সিস্টেমটা একটু বলে ফেলি। জাতিসংঘের সার্বজনীন ঘোষণা অনুযায়ী ১২ বছর হবে প্রাথমিক শিক্ষা (এলিমেন্টারী এন্ড ফান্ডামেন্টাল এডুকেশন) এরপর টেকনিক্যাল এন্ড প্রফেশনাল এডুকেশন (এমবিবিএস/অনার্স) এরপর হায়ার এডুকেশন। এ সিস্টেমেই চলছে কোরিয়ান এডুকেশন সিস্টেম যার ১ম ৫-৭ বছর: কিন্ডারগার্টেন, ৮-১৩ বছর: এলিমেন্টারি স্কুল; ১৪-১৬ বছর: মিডস্কুল বা হাইস্কুল; ২০ বছরের পর মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা দিয়ে ঢুকতে হয়। আবার গ্রাজুয়েশন ছয় বছর যার প্রথম বছর ম্যাথ, ফিজিক্স,ইথিক্স, মেডিকেল ল, সোসাল সায়েন্স এসব পড়ানো হয়। আর ৫ম ও ৬ষ্ঠ বছরে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট এ প্লেসমেন্ট থাকে। ১ বছর ইন্টার্নশীপ। এরপর শুরু হয় রেসিডেন্সি। ৪ বছরের কোর্স। তবে থাইল্যান্ডে মাহিদল বিশ্ববিদ্য়ালয়ে দেখেছি রেসিডেন্সি তিন বছর মাদার সাবজেক্টের উপর(এ সময়ে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে বাংলাদেশের ফেজ এ-র মতো প্লেসমেন্ট থাকে।) এর পর দুবছর ফেলোশীপ করে নির্দিষ্ট সুপার স্পেশালিটিতে এক্সক্লুসিভ ট্রেনিং নিতে হয়।

বয়স ৩০ বছরের মধ্যে আবার তিন বছর আর্মিতে অথবা ডাক্তারদের সিভিল সার্ভিস হিসাবে গ্রামে পোস্টিং যেতে হবে। থাকতেই হবে, ফরজ। কে কোনটায় যাবে, ঠিক করে দেবে সরকার।
আমি সব সাবজেক্টের কথাতো আর বলতে পারবোনা। ফিজিক্যাল মেডিসিনের কথা বলি।
কোরিয়ার ইন্সস্টিটিউট বা হাসপাতালে রেসিডেন্টরাই সব কাজের কাজী। থাইল্যান্ডের সিরিরাজেও দেখেছি, ফেলোরাই মূল কারিগর, রেসিডেন্টরা সহযোগী। আর কোরিয়াতেও দেখলাম এখানের সব কাজ রেসিডেন্টরা করবে। ব্যাখ্যা হলো, তুমি করলেই, তুমি শিখবে।
ইয়ার ১- সব ওয়ার্ড রাউন্ড, হিস্ট্রি নেয়া, রোগীর ফলো আপ সব করবে। ওটিতে ইন্টারভেনশন, ভিডিও ফ্লুরোস্কপি সব প্রথম বর্ষে।

ইয়ার ২- সব নিউরো ডায়াগণস্টিক টেস্ট রেসিডেন্টরা করবে। আউটডোরে প্রফেসরদের সাথে বসবে। রোগীর পুরো হিস্ট্রি ও এসেসমেন্ট তারাই করবে। আর লাস্ট ইয়ার রেসিডেন্টরা মেডিকেল অফিসারের মত রোগী দেখবে এবং প্রফেসরের কাছে রেফার করবে।
এরা হাসপাতালে সকাল ৮টায় আসে, যায় বিকাল ৫টায়। দিনের মাঝে ব্রেক দুঘন্টা। এবসলিউট ব্রেক, নো কাজ। এর পরে রোগী বা কাজ না থাকলেও রিসার্চ বা পেপার লিখা বা জার্নাল ক্লাব। মাসে কমপক্ষে ২-৩টি সেশন পরিচালনা করতে হয়।

গতানুগতিক কোন লেকচার ক্লাস নেই। পেশেন্ট বেজড ডিশকাশন। প্রফেসররা নন, সব লেকচার ক্লাসগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিচ্ছে রেসিডেন্টরা। সপ্তাহে চারদিন কনফারেন্স/ক্লাস.ডিশকাশন। কোন রোগী ভর্তি হবার পর সেটা নিয়ে বেসিক কথা ও এরপর রোগী নিয়ে আলোচনা। অধ্যাপকরা এই মাসে কোন ক্লাস নিয়েছেন, দেখিনি। তবে সবাই তার সুপারভাইজড রেসিডেন্টের প্রেজেন্টেশন নিয়ে আগের দিন বসেছেন। তবে ওদের সবার এমবিবিএস কারিকুলাম খুবই স্ট্রং।

অন্যগুলোতেও দেখলাম, গতানুগতিক লেকচার বলতে যা বুঝায়, তার সব দায়িত্ব ট্রেইন ফেলোদের আর রেসিডেন্টদের। শিক্ষকগণ এর বাইরে কোন কথা থাকলে কন্ট্রিবিউট করেন।
খুব অবাক হয়ে শুনলাম, রেসিডেন্সি শেষ হবার মাঝে সকল রেসিডেন্টের কমপক্ষে ৪-৫টি পেপার পাবলিশ হয়ে যায়। অবশ্যই বেশিরভাগ কো-অথর। প্রফেসাররা তাদের নাম দেয়ার জন্য নিজেরাই এসিস্টেন্ট বানিয়ে নেন। আর কেস রিপোর্ট মানেই রেসিডেন্ট ফার্স্ট অথর।

বার্ষিক কনফারেন্সে দেখতে পেলাম সিনিয়র প্রফেসর তার নিজের একটি অসাধারন ও মৌলিক গবেষণা, কনফারেন্সে তার সিনিয়র রেসিডেন্টকে দিয়ে প্রেজেন্ট করালেন। ছেলেটা সেটা প্রেজেন্ট করে পুরষ্কারও পেয়ে গেল। এটা নাকি তার পোর্টফোলিও সমৃদ্ধ করবে। অসাধারন।

খুব অদ্ভুত একটি বিষয় দেখলাম এদের বেশিরভাগই রেসিডেন্ট অবস্থায় কোন সোসাল মিডিয়া ব্যবহার করেনা। ফেসবুক বা নিজেদের দেশীয় কোন মিডিয়ায় নেই বেশিরভাগই। একজনকে জিজ্ঞাসা করায় বললো, এটা কাজের সময় আর ঘূমের সময় কেড়ে নেয়। আমি বাকরুদ্ধ।

সময়ের ব্যাপারে একদম নো কম্প্রমাইজড। ৮টার ক্লাস ৮টায় আর শেষ হবার টাইমে সর্বোচ্চ ৫ মিনিট এদিক-সেদিক, তার বেশি নয়। বরং আমিই শুরুতে দু একদিন ৫-৭ মিনিট লেট করে লজ্জা পেয়েছি।

শিক্ষকরা প্রত্যেক রেসিডেন্টের জন্য ডেস্ক ‍ও কেবিনেট বরাদ্দ করে দিয়েছেন। একেকটা টেবিল তো নয়, চলমান বাসা আর লাইব্রেরি। লিপস্টিক, চকলেট, এক্সট্রা ড্রেস, নিজের ঔষধ, প্রসাধন, ব্রাশ-টুথপেস্ট সবই পাবেন ডেস্কে। নিজের ডেস্কটাই তার ঘর। প্রফেসরদের তারা মোটামুটি দেবতা বলে গণ্য করে। শিক্ষকরাও প্রত্যেক রেসিডেন্টদের সাথে পরিবারের মতো করে এটাচড। টিপিক্যাল গুরু-শিষ্য দুরত্ব এখানে এক সেকেন্ডও দেখিনি। প্রত্যেক প্রফেসর তার কলিগ ও রেসিডেন্টদের নিয়ে রিসার্চ প্রজেক্টে চালান। পেপারে উদার মনে নাম দিচ্ছেন। থিসিস এর আগে ধরে ধরে বুঝাচ্ছেন।

রেসিডেন্টরা পরষ্পরের জন্য ভয়ানক অন্তপ্রাণ। একই ইয়ারের কলিগ কারো একটু লোড হচ্ছে, নিজেই করে দিচ্ছে। সিনিয়রের পরীক্ষা, নিজেদের মাঝে কাজগুলো ভাগ করে নিচ্ছে। অসাধারন টিম স্পিরিট। আর রোগীদের প্রতি তাদের যে ডেডিকেশন, সেটি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কাজ যে একটি প্রেসার বা মাত্রা বা সংখ্যা, কাজে যে কষ্ট লাগে- এ বিষয়টি আপনি তাদের ব্রেনে আসতে দেখিনি।

জাপানীরা নাকি বিনয়ে পৃথিবী সেরা, দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু কোরিয়াতে একজন বিদেশী হিসাবে যে ট্রিট পেয়েছি, তাতে আমি মানবিক গুনাবলীর দিক দিয়ে তাদের কোন অংশে পিছিয়ে রাখবোনা।

পরিশেষে বলব. এ গুণ শুনে বাংলাদশে কারো মনোকষ্টে ভোগার দরকার নেই। বাংলাদেশের বহু বহু রেসিডেন্ট/ট্রেইনিরা স্বতস্ফুর্তভাবেই অসাধারন ট্রেনিং সময় পার করেন। আর বহু বহু শিক্ষকের মায়ায় জড়িয়ে আমরা আজকে এখানে এসেছি। তবে বেতনটা জানিয়ে শেষ করি। একজন রেসিডেন্ট মাসে মোটামুটি যা নিয়মিত পান তার পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার টাকা, সাথে থিসিস গ্রান্ট আর প্রফেসরদের প্রজেক্টে থাকলে তার বাড়তি সম্মানীতো আছেই।

আরও পড়ুন