Advertisement
Doctor TV

বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫


উচ্চ রক্তচাপ নীরব ঘাতকের মত : অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান

Main Image

উচ্চ রক্তচাপ নীরব ঘাতকের মত : অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান


হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ হলো ‘নীরব ঘাতক। অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাবিহীন উচ্চরক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। ১৭ মে বিশ্ব হাইপার টেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ দিবস উপলক্ষে ডক্টর টিভি অনলাইনকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কার্ডিওলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান (অবসরপ্রাপ্ত)।

তিনি বলেন, হাইপারটেনশন এর আরেক নাম উচ্চ রক্তচাপ। মানুষের শরীরের রক্তনালী দিয়ে রক্তপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার সময় সাধারণত চাপ তৈরি হয়। স্বাভাবিকভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের রক্তচাপ থাকে ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি। কারও ব্লাড প্রেশার রিডিং যদি ১৪০/৯০ বা এর চেয়েও বেশি হয়, তখন বুঝতে হবে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে।

রক্তচাপের মাত্রা ১২০/৮০ থেকে ১২৯/৮০ মিমি পর্যন্তকে বলা হয় উচ্চ রক্তচাপের পূর্বাবস্থা বা প্রি-হাইপারটেনশন। রক্তচাপ যদি ১৩০/৮০ মিলিমিটার মারকারি বা তার ওপরে থাকলে তাকে হাই ব্লাড প্রেসার, হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। তবে কারো রক্তচাপ একবার মেপেই নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এক বা দুই সপ্তাহ প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার রক্তচাপ মাপতে হবে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান বলেন, শুরুতে কোন মানুষই উচ্চরক্তচাপ বুঝতে পারেন না। কেউ কেউ হাসপাতালে গিয়ে রুটিন চেকআপ করে থাকেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তাদের কারো হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা জানা সম্ভব। সাধারণত: সার্জারির আগে রোগীর উচ্চরক্তচাপ আছে কি-না সেটা পরীক্ষা করা হয়। হাই-প্রেসারের কারণে কারো মাথা ব্যাথা বা ঘাড় ব্যাথা হতে পারে। শরীরের ভেতরে অস্বস্তি লাগতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া.. ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।

তিনি বলেন, অনেকদিন ধরে হাই-প্রেসার বা উচ্চরক্তচাপ থাকলে- এবং সেটার কোন চিকিৎসা না করালে সেটার ফলে পা ফুলে যেতে পারে। আবার হার্টের ওপর বিরূপ প্রভাবও ফেলে। এমনকি হার্ট ফেইলিওরও হতে পারে।

হাইপারটেনশনের কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান জানান, পারিবারিক কারণে হাইপার টেনশন হতে পারে। অর্থাৎ বাবা-মায়ের থাকলে সন্তানেরও হাইপারটেনশন হতে পারে। ইনভারনমেন্টাল কারণেও হাইপারটেনশন হতে পারে। কর্মক্ষেত্রের জটিলতা থেকেও এটা হতে পারে। কর্মহীনতা, দুশ্চিন্তা থেকেও হাইপারটেনশন হতে পারে।
কারো কারো শরীরের রক্ত নারী সরু হয়ে আসে। এরফলে সিস্টোলিক হাইপারটেনশন হতে পারে। কিছু কিছু রোগ থেকেও উচ্চরক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। এ কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল- কিডনির রোগ, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার, ধমনির বংশগত রোগ, গর্ভধারণ অবস্থায় অ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি-অ্যাকলাম্পসিয়া হলে হাইপার টেনশন হতে পারে। তাছাড়া অনেক দিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েডজাতীয় হরমোন গ্রহণ এবং ব্যথানাশক কিছু কিছু ওষুধ খেলে তার প্রভাবেও হাইপার টেনশন হতে পারে। ডায়াবেটিস থেকেও হাইপারটেনশন হতে পারে বলে জানান তিনি।

হাইপারটেনশনের ভয়াবহতা সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান বলেন. সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসা না হলে- হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ থেকে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। কিডনি নষ্ট হতে পারে। হার্ট ফেইল করতে পারে। চোখ নষ্ট পারে। গুরুত্ব অর্গানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে, হয়তো বা তৎক্ষনাৎ রোগী মরবে না- কিন্তু এরফলে রোগী বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়বে। কার্ডিও ভাসকুলার ডিজিস তথা ব্রেইনে স্ট্রোক হতে পারে। এতে মানুষ মারা যেতে পারে।

তিনি বলেন, হাইপারটেনশনকে প্রাথমিক হাইপারটেনশন অথবা গৌণ হাইপারটেনশনে ভাগ করা হয়। প্রায় ৯০–৯৫% ভাগ ক্ষেত্রেই "প্রাথমিক হাইপারটেনশন" বলে চিহ্নিত করা হয়। বাকি ৫-১০% বিভিন্ন রোগের কারণে হয়।[

হাইপারটেনশন বা উচ্চরক্তচাপ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে প্রবীন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান বলেন, যাদের মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের রক্তচাপ রয়েছে- তাদেরকে ওজন কমানো এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। দুশ্চিন্তা বা টেনশন ফ্রি থাকতে হবে। ধূমপান ও মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে।

মাঝারি থেকে উচ্চ রক্তচাপে ভূগছেন এমন রোগীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ওষুধ সেবন করতে হয়। অনেকেই মেডিসিন নেয়ার পর, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ সেবন বন্ধ করে দেয়। এই প্রবণতাটা অনেক বিরামহীন চলছে। এফলে হঠাৎ করে রক্তচাপ বেড়ে অনেক খারাপ পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

এ কারণে রোগীদেরকে বলবো- নিজেরা ইচ্ছে মাফিক হাইপারটেনশনের ওসুধ সেবন করবেন না। রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ মাফিক ওষুধের ডোজ কমবেশি করা যেতে পারে।
ধূমপান ছেড়ে দেয়া সরাসরি রক্তচাপ কমায় না। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের সাথে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে উচ্চ রক্তচাপের বেশকিছু উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে আসে। ফল, শাক সবজি, ননি ছাড়া দুধজাত খাদ্য এবং অল্পমাত্রার লবণ ও তেলের খাদ্য উচ্চ রক্তচাপ বিশিষ্ট রোগীর রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করতে হবে। এতে দেহের রক্ত চলাচলের উন্নতি হয়। এবং রক্তচাপ কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও পরিবেশগত চাপ যেমন উঁচু মাত্রার শব্দের পরিবেশ বা অতিরিক্ত আলো পরিহার করাও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য উপকারী হতে পারে।

চিকিৎসা ও ওষুধ সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান বলেন, বাজারে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা রকমের ওষুধ পাওয়া যায়। সেগুলো অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ নামে পরিচিত। রক্তচাপ ৫-৬ টর কমালে তা স্ট্রোকের ঝুঁকি প্রায় ৪০%, করোনারী হৃদরোগের ঝুঁকি প্রায় ১৫-২০% কমিয়ে আনে এবং হার্ট ফেইলিউরের আশঙ্কাও কমে আসে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে প্রচলিত ওষুধের মধ্যে আছে-, বিটা ব্লকার যেমনঃ metoprolol, atenolol, labetalol, carvedilol, এসিই নিরোধক যেমনঃ lisinopril, quinapril, fosinopril, captopril, enalapril, ramipril; এনজিওটেসটিন রিসিপটর ব্লকার (এআরবি) যেমনঃ losartan, valsartan, irbesartan; ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার যেমনঃ amlodipine, verapamil; ডাইইউরেটিকস, যেমন chlortalidone, hydrochlorothiazide (এইচসিটিজেট), মিশ্র ঔষধ (সাধারণত এইচসিটিজেট এবং অন্য একটি ঔষধ একত্রে), এবং আলফা ব্লকার যেমন terazosin এবং prazosin । রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক ঔষধের প্রয়োজন হতে পারে। তবে রেজিস্ট্রার্ড এবিবিএস চিকিৎসক ছাড়া কোন ভাবেই এসব ওষুধ গ্রহণ করা উচিত হবে না। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে হাইপারটেনশনের ওষুধ দেয়া হয় বলে জানান প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান (অবসরপ্রাপ্ত)।

আরও পড়ুন