Ad
Advertisement
Doctor TV

মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫


অপাপবিদ্ধ বন্ধন

Main Image

কল্পোচিত্রে নারীর কোলে শিশু


চেম্বারে রোগী দেখছি।

হঠাৎ দরজায় প্রচন্ড করাঘাত। বিদ্রোহী কবিতার ‘কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’ পঙতিটির কথাই মাথায় আসছিল তখন। কাঁচের দরজা হলেও কাগজ সাঁটানো থাকায় ওপারের মানুষটিকে দেখা যাচ্ছিলো না। অনবরত করাঘাতের শব্দে খানিক অতিষ্ঠ হয়ে রোগীর স্বামীকে অনুনয় করে বললাম,

-দয়া করে দরজাটা একটু খুলে দেবেন?

স্লাইডিং দরজাটির কিছু অংশ উন্মুক্ত করতেই ফাঁক গলে প্রত্যয়ী ভঙ্গীতে ভেতরে যিনি ঢুকলেন তিনি আড়াই ফুট উচ্চতার একজন ক্ষুদ্র মানব। বিশ্বজয়ের আনন্দ উনার চোখে মুখে। ক্ষুদ্র, শুভ্র দাঁতগুলো বিকশিত করে তিনি আমার পানে তাকিয়ে হাসছেন আর অনর্থক শব্দ করছেন।
রোগী ও তার স্বামী ব্যাপারটিতে খুব মজা পাচ্ছিলেন।

হঠাৎ করে ক্ষুদে মানবটি দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে এক হাত বাড়িয়ে দিলেন। রোগির স্বামী হাতটি ধরলে তিনি এক ঝটকায় হাতটি ছাড়িয়ে নেন এবং চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন।
অগত্যা আমি উঠে গিয়ে ছোট্ট কোমল হাত ধরতেই উনি যেন কৃতার্থ হলেন। থপ থপ করে চেয়ার অব্দি আসতেই আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন দুই হাত। আবদার ও আহ্লাদ রক্ষার্থে উনাকে কোলে তুলে নিলাম। দুহাতে আমার গলাটি বেষ্টন করে তিনি পরম নির্ভরতায় আমার কাঁধের উপর মাথা রেখে চোখ দুটি বুজলেন।

উনাকে কোলে নিয়েই পূর্বের রোগীটিকে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বিদায় জানালাম।

মানবটির পরিচয় হচ্ছে, উনি উনিশ মাস বয়সী একজন শিশু এবং আমার নিয়মিত রোগী। প্রায় ছয় মাস বয়স থেকেই যেকোন সমস্যায় আক্রান্ত হলেই তিনি আমার দ্বারস্থ হন। এ কদিনেই আমার সাথে তার যে সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে তার আসলে কোন নাম নেই। কেন যে আমাকে এত ভালোবাসেন তাও ব্যাখ্যাসাধ্য নয়। তবে এই বিস্ময় বালকটি আমার অপার্থিব আনন্দের খোরাক।

রোগী বের হতেই শিশুটির বাবা মা আমার কক্ষে ঢুকলেন। কোলে শিশুটিকে দেখে খানিক বিমূঢ় ও লজ্জিত হলেন। দুজনেই কোল থেকে নামার জন্য তাকে যত অনুনয় বিনয় করেন উনি তত শক্ত করে আমাকে আঁকড়ে ধরে আমার বুকের সাথে মিশে যান। অগত্যা কোলে নিয়েই উনার রোগের উপসর্গগুলো শুনি আর শারীরিক পরীক্ষা করি।

এবার বিদায়ের পালা। কিন্তু উনি কোল থেকে নামবেন না। বাবা মা জোর করছেন তবু ও না। এদিকে চেম্বারের সময় পেরিয়ে গেছে ২০-২৫ মিনিট। উনারা বারবার আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন। আর শিশুটিকে বকছেন। শিশুটিও তারস্বরে চিৎকার করছে আর আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে শক্ত করে। এবার আমি মুখ খুললাম।

-যাও সোনা। মায়ের কাছে যাও। এক্ষুনি দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর অন্ধকার হবে। আমরা সবাই ভয়েই মরে যাব।

শিশুটি কি বুঝলো জানি না তবে বন্ধন কিছুটা আলগা হলো। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো আর গালে একটা চুমু খেল। তারপর নির্দ্বিধায় মায়ের কোলে চলে গেল। আমিও ওর কপালে চুমু খেয়ে বিদায় জানালাম।

এটা কিন্তু তার নিয়মিত ঘটনা।

বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছি, আত্মীয়তার বন্ধনহীন এই সম্পর্কের কি আসলে কোন নাম বা সংজ্ঞা আছে? আমার প্রতি এই দেবশিশুটির অমোঘ আকর্ষন কি ব্যাখ্যাতীত নয়? এর চাইতে অকৃত্তিম, নিষ্পাপ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর কি কিছু হতে পারে?

মহাজাগতিক সফরের এই ক্ষুদ্র পরিভ্রমনে বিধাতার কাছে আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।
আমি পরিতৃপ্ত, আমি কৃতজ্ঞ।

আরও পড়ুন