ছবিঃ সংগৃহীত
মানুষের জীবনে হাসি ও স্বপ্নের আড়ালে লুকিয়ে থাকে অজানা লড়াই। অনেকে বাইরে স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে ভেতরে নিঃশব্দ যুদ্ধে লিপ্ত, কারও মনে জমে থাকে অপ্রকাশিত কষ্ট, কেউ আবার নীরবে ভেঙে পড়েন একাকীত্বের ভারে। মনও যত্ন চায়, চায় সহানুভূতি ও বোঝাপড়া যেমন শরীর বিশ্রাম চায়। তাই মানসিক সুস্থতা আজ কেবল কামনা নয়, বরং টিকে থাকার অপরিহার্য শর্ত। এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিয়েছে ‘মনতরঙ্গ’, বাংলাভাষী একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায় সপ্তাহের প্রতিদিন, দিনে ২৪ ঘণ্টা।
গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৮–১৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১২.৬–১৩.৬ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক সমস্যায় ভুগছে। অথচ মানসিক সহায়তা এখনো অনেকের কাছে অপ্রাপ্য। এই বাস্তবতায় কয়েকজন তরুণ প্রথমবারের মতো তৈরি করেছেন ‘মনতরঙ্গ’ একটি ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন (https://montorongo.com/) যা ডিপ্রেশন, উদ্বেগসহ নানা মানসিক চাপের সময়ে ব্যবহারকারীর পাশে দাঁড়ায় সহানুভূতিশীল কথোপকথনের মাধ্যমে। এটি শুধু তথ্য সরবরাহ করে না, বরং সহমর্মিতা, দিকনির্দেশনা ও আবেগীয় সমর্থনের মাধ্যমে মানসিক সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে।
এই মানবিক উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, নির্ঝর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব সাইবারজায়া, বিএএফ শাহীন কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং গভর্নমেন্ট সায়েন্স কলেজের শিক্ষার্থীরা একসাথে কাজ করছেন। তারা প্রমাণ করছেন যে শ্রেণিকক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে মানুষের পাশে থাকাই শিক্ষার প্রকৃত আলো।
মনতরঙ্গের লক্ষ্য হলো ১৩ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান তৈরি করা, যেখানে তারা মানসিক চাপ কমাতে, স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে এবং প্রয়োজনে পেশাদার সহায়তা নিতে অনুপ্রাণিত হবে। এটি বিনামূল্যে, সহজলভ্য ও কলঙ্কমুক্ত মানসিক সহায়তা প্রদান করে। প্ল্যাটফর্মটি অনলাইন চ্যাটবটের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধি নিয়োগের মাধ্যমে সেবা পৌঁছে দিতে চায়। স্মার্টফোন ব্যবহারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এটি মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির একটি হাতিয়ার হিসেবে গড়ে উঠছে।
এ প্ল্যাটফর্মে রয়েছে ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় এআই চ্যাটবট সহায়তা, যা টেক্সট ছাড়াও ফোন কলে ব্যবহারকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে এবং স্বরের ফ্রিকোয়েন্সি বিশ্লেষণ করে মানসিক অবস্থা শনাক্ত করতে সক্ষম। ব্যক্তিগত মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় রয়েছে মুড ট্র্যাকিং, জার্নালিং ও আবেগ প্রতিফলনের মতো সরঞ্জাম। পাশাপাশি, বিষণ্নতা ও উদ্বেগ শনাক্তে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত পিএইচকিউ-৯ এবং জিএডি-৭ মূল্যায়ন টেস্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেসব দিনে ব্যবহারকারী স্ব-যত্ন ভুলে যান, মনতরঙ্গ তাদের সতর্ক করে, অনুপ্রেরণা দেয় এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনে যার মাধ্যমে ভালো অভ্যাস গড়ে ওঠে।
গুরুতর মানসিক অবস্থায় প্ল্যাটফর্মটি দ্রুত পেশাদার সহায়তার নির্দেশনা দেয় এবং অফলাইন সহায়ক সামগ্রী যেমন ভিডিও, অডিও, নিবন্ধ, বাস্তব গল্প ও ইন্টারঅ্যাকটিভ টুলস সরবরাহ করে, যা সংকটের সময় ব্যবহারকারীর মানসিক স্থিতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। মনতরঙ্গ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাষা, সংস্কৃতি ও সংবেদনশীলতাকে মাথায় রেখে তৈরি এটি কেবল যান্ত্রিক চ্যাটবট নয়, বরং একজন বন্ধুর মতো আবেগীয় সহযাত্রী। এখানে নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে সমস্যাগুলো প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত হয়।
ব্যবহারকারীর কথোপকথন থেকে সমস্যার লক্ষণ শনাক্ত করা, তাদের অনুভূতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা, শ্বাস-প্রশ্বাস ও মননশীলতার কৌশল ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া এসবই এর কাজের অংশ। গুরুতর অবস্থা শনাক্ত হলে এআই মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয় এবং প্রয়োজনে মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হওয়ার নির্দেশনা দেয়। এই প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় প্রায় ১০ জন অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী ও ১৫ জন প্রশিক্ষিত মেডিকেল শিক্ষার্থীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে, যারা নিশ্চিত করেন প্রতিটি কথোপকথন যেন সহানুভূতিপূর্ণ, তথ্যভিত্তিক ও কার্যকর হয়।
২০২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক সংস্থা মনতরঙ্গ তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় ডিজিটাল উদ্ভাবন ও কমিউনিটি এনগেজমেন্টের মাধ্যমে একটি টেকসই সংস্কৃতি গড়ে তুলছে। এটি কেবল একটি প্রযুক্তি নয়, বরং এমন এক উদ্যোগ যেখানে দেশি-বিদেশি মনোবিজ্ঞানী ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা একসাথে কাজ করছেন যাতে তরুণরা মানসিক যাত্রায় কখনো একা না থাকে, বরং প্রতিটি ধাপে পাশে পায় একজন সহানুভূতিশীল সঙ্গী।
আরও পড়ুন