ছবিঃ সংগৃহীত
এক সময় গ্রামবাংলার দুপুরবেলা মানেই ছিল হাঁড়িতে ফুটতে থাকা শাপলার ডাটা দিয়ে রান্না করা চচ্চড়ির ঘ্রাণ। বাড়ির উঠানে কাটা শাপলার ডাটা, কচি আলু আর কাঁচা মরিচের গন্ধে ভরে যেত পুরো পরিবেশ। অথচ আজকের প্রজন্মের অনেকেই এই অমূল্য জলজ সবজিটির নামই ঠিকমতো শোনেনি। শাপলার ডাটা শুধু যে স্বাদের দিক থেকে অনন্য তা নয়, এটি একটি পুষ্টির আধার, যার গুরুত্ব সময়ের সঙ্গে আরও বেড়েছে।
শাপলার ডাটা আসে আমাদের চিরচেনা শাপলা ফুল থেকে। জলাশয়ে ভেসে থাকা এই ফুল যেমন আমাদের জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে, তেমনি এর কন্দ ও ডাটা যুগ যুগ ধরে হয়ে উঠেছে রান্নাঘরের নির্ভরযোগ্য উপকরণ। একে স্থানীয়ভাবে ‘ডাটা’ বলা হলেও এর গঠন অনেকটা লতানো ও রগড়ানো জাতীয় যা ভাজি, চচ্চড়ি কিংবা স্যুপে দিয়ে অনায়াসেই ভিন্ন স্বাদের খাবার বানানো যায়।
গ্রামের মানুষ জানে, বর্ষায় জলমগ্ন মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা শাপলার ভেতরেই লুকিয়ে আছে স্বাস্থ্যরক্ষার এক প্রাকৃতিক গোপন ফর্মুলা।
খনিজ পদার্থের শক্তি
শাপলার ডাটা শুধু ভিটামিনেই নয়, খনিজ উপাদানেও সমৃদ্ধ। এতে থাকা ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠন মজবুত করে, আয়রন শরীরের রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে এবং ম্যাগনেসিয়াম স্নায়ু ও পেশির সুসমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে নারীদের জন্য আয়রন এবং ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খুব দরকার এই ডাটা হতে পারে সাশ্রয়ী ও স্বাস্থ্যকর সমাধান।
ভিটামিনের ভাণ্ডার
পুষ্টিবিদদের মতে, শাপলার ডাটায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’ ও ‘ই’। ভিটামিন ‘এ’ চোখের দৃষ্টিশক্তি রক্ষায় অপরিহার্য, যা শিশু থেকে শুরু করে বয়স্কদের জন্য সমানভাবে উপকারী। ভিটামিন ‘সি’ দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে, ত্বক উজ্জ্বল রাখে এবং শরীরকে নানা সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। আর ভিটামিন ‘ই’ হলো অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ উপাদান, যা বার্ধক্যজনিত প্রভাব কমিয়ে কোষকে রাখে তরতাজা।
পেটের বন্ধু
আজকের ব্যস্ত নগরজীবনে হজম সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য ও উচ্চ রক্তচাপ যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। শাপলার ডাটা এসব সমস্যার প্রতিকারে কার্যকর একটি প্রাকৃতিক উপাদান। এতে থাকা উচ্চমাত্রার ফাইবার পাচনতন্ত্র পরিষ্কার রাখে এবং হজমের গতি বাড়ায়। ফাইবারযুক্ত খাবার রক্তে কোলেস্টেরল কমায়, যা হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
নানা স্বাদের সম্ভার
শাপলার ডাটা দিয়ে তৈরি খাবারের বৈচিত্র্যও বেশ চমকপ্রদ। এটি মাছ, মাংস, ডাল বা মসলা জাতীয় উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে সহজেই সুস্বাদু খাবারে পরিণত করা যায়। ভাজি, চচ্চড়ি, ভর্তা, ঝোল, এমনকি মিক্সড সবজি হিসেবেও এটি বেশ জনপ্রিয়।
বর্তমান প্রজন্মের খাদ্য তালিকায় জাঙ্ক ফুড, প্রসেসড খাবার ও কৃত্রিম স্বাদের আধিক্য দেখা গেলেও আমাদের দেশীয় ও প্রাকৃতিক খাবারগুলোর গুরুত্ব কখনোই কম নয়। বরং এখন সময় এসেছে সেই হারিয়ে যেতে বসা পুষ্টিকর ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার। শাপলার ডাটা সেই ধারার একটি দৃষ্টান্ত। এটি শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজলভ্য নয় একই সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যেরও বিশ্বস্ত রক্ষাকবচ।
শাপলার ডাটা যেন আমাদের মাটির গল্প বলে। গ্রামবাংলার জলাভূমির এই অনন্য উপহার কেবল খাদ্য নয়, এটি সুস্থতার এক সহজ সমাধান। তাই এখন সময় এই পুষ্টিগুণে ভরপুর জলজ সবজিটিকে নতুন প্রজন্মের ডাইনিং টেবিলে ফিরিয়ে আনার। রান্না ঘরে শাপলার ডাটা মানেই স্বাদ, স্বাস্থ্য আর শেকড়ের সংযোগ একটি সবুজ গল্প, যা প্রতিদিনের থালায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
আরও পড়ুন