নিশাদ তাসনিমঃ
ঢাকার প্রতিটি প্রান্তে চলছে নির্মাণ—নতুন ভবন, রাস্তা, সেতু। কিন্তু এই নগর গড়ার মানুষেরা, নির্মাণশ্রমিকরা, কেমন আছেন, কীভাবে বাঁচছেন, কী নিঃশ্বাস নিচ্ছেন—তা আমরা ক’জনই বা দেখি? যখন বায়ুদূষণ এক নীরব মহামারির মতো শহরের ফুসফুস দখল করে নিচ্ছে, তখন সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন এই নির্মাণশ্রমিকরাই। এই বাস্তবতা থেকেই জন্ম নেয় Prosshash—একটি মেডিকেল শিক্ষার্থী পরিচালিত প্রকল্প, যা নগরের নির্মাণসাইটে কাজ করা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের অধিকারকে সামনে আনে।
২০২৫ সালে, বাংলাদেশ মেডিকেল স্টুডেন্টস’ সোসাইটি (BMSS) অংশ নেয় The Earth-এর Eco Leaders Seed Fund প্রতিযোগিতায়। শতাধিক আবেদনকারীর মধ্য থেকে নির্বাচিত হয় সেরা প্রকল্প—Prosshash: Breathing Life into Dhaka। প্রকল্পটি শুধু সচেতনতা সৃষ্টি নয়, বরং নীতিনির্ধারণ, জনসম্পৃক্ততা এবং বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে একটি পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের পথে যাত্রা শুরু করে।
প্রথম পর্যায়ে আমরা ঢাকা শহরের পাঁচটি নির্মাণ ক্লাস্টারে সরাসরি গিয়ে শ্রমিকদের সাক্ষাৎকার নিই, পরিবেশ বিশ্লেষণ করি, রুটিন চেক-আপ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির ডকুমেন্টেশন করি। প্রায় প্রত্যেক শ্রমিক জানান, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্ট, চোখে জ্বালা, কাশি ইত্যাদি সমস্যায় ভুগছেন। কোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগ নেই, নেই পর্যাপ্ত পানি, ছায়া কিংবা ন্যূনতম সুরক্ষার ব্যবস্থাও। এই তথ্যের ভিত্তিতে আমরা একটি প্রতিনিধি দল পাঠাই পরিবেশ অধিদপ্তরে এবং ঢাকার পাঁচটি নির্মাণ সাইটে আয়োজন করি মেডিকেল ক্যাম্প। সেখানে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং স্পিরোমেট্রি স্ক্রিনিং করা হয়। প্রায় ১৫০ জন নির্মাণ শ্রমিকের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা যাচাই করে দেখা যায়,১০০ এরও অধিক শ্রমিক ধুলাবালির কারণে ভুগছেন শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগে।
সেখানে শ্রমিকদের মাঝে বিনামূল্যে ওষুধ, মাস্ক এবং সচেতনতামূলক স্বাস্থ্য নির্দেশনা বিতরণ করা হয়। আমরা লিখিতভাবে সুপারিশ করি—নির্মাণ সাইটে গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক করা, শ্রমিকদের জন্য মাস্ক ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা, প্রতিটি নির্মাণ প্রকল্পের অনুমতির আগে পরিবেশবান্ধব নীতির বাস্তবায়ন এবং নির্মাণ লাইসেন্সের সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার প্রতিশ্রুতি সংযুক্ত করা। অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (DNCC)-এর সদর দফতরে গিয়ে আমাদের প্রতিনিধি দল উপস্থাপন করে কীভাবে নগরের প্রতিটি নির্মাণ অনুমতির সময় স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত গাইডলাইন অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আমরা “Cluster Greening Planning”-এর বাস্তব উদাহরণ দেখিয়ে DNCC কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করি এই মডেল গ্রহণের জন্য।
প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সরাসরি নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। আমরা প্রতিনিধি দল পাঠাই পরিবেশ অধিদপ্তরে—পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো: জিয়াউল হক এবং উপপরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) বেগম শাহানাজ রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং তুলে ধরি নির্মাণসাইটে ধুলোর স্বাস্থ্যঝুঁকি, মাস্ক ও সুরক্ষা উপকরণের অভাব এবং নির্মাণ পর্যায়ে কোনো পরিবেশনীতি প্রয়োগ না থাকার বিষয়টি। আমরা জমা দিই একটি লিখিত সুপারিশপত্র, যেখানে উল্লেখ থাকে—প্রতিটি নির্মাণসাইটে গাছের বাধ্যতামূলক উপস্থিতি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা ও মাস্ক বিতরণ, নির্মাণের আগে পরিবেশবান্ধব নীতির চেকলিস্ট এবং নির্মাণ লাইসেন্সের সঙ্গে পরিবেশ রক্ষা প্রতিশ্রুতি যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা।
এই প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল গাছ লাগানো, তবে শুধু প্রতীকী নয়—বাস্তবিক উদাহরণ তৈরি করা। আমরা নির্মাণসাইটগুলোর পাশে টবে গাছ লাগিয়ে “Cluster Greening”-এর একটি বাস্তব চিত্র গড়ে তুলি, যেখানে শ্রমিকরাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
২৯ মে ২০২৫, ঢাকার রাস্তাগুলো যখন জলমগ্ন, আকাশে বজ্রসহ বৃষ্টি—তখনও আমরা থেমে থাকিনি। এই দিনেই অনুষ্ঠিত হয় Prosshash-এর কেন্দ্রীয় র্যালি। ভিন্ন ভিন্ন ক্লাস্টারে প্রতিটিতে প্রায় ৪৫ জন করে মেডিকেল শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবক অংশ নেন। হাতে প্ল্যাকার্ড, মুখে স্লোগান—শহরের বুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সবুজের ডাক।
র্যালির স্লোগান ছিল:
“ধোঁয়া নয়, সবুজ চাই—বাঁচতে হলে গাছ লাগাই!”
“একটা কাটলে দুটো লাগান, শহরটা হোক সবুজ বাগান”
“বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস—গাছ কাটলে সর্বনাশ!”
এই স্লোগানগুলো শুধু আওয়াজ ছিল না—ছিল আন্দোলনের ভাষা, একটানা প্রয়াসের প্রতীক। এরপর আয়োজিত হয় Prosshash Photo Exhibition, যেখানে দুই শতাধিক মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ক্যামেরাবন্দী করা ছবি থেকে বাছাইকৃত ছবি নিয়ে তুলে ধরা হয় শ্রমিকদের বাস্তব চিত্র, তাদের কর্মপরিবেশ এবং ধুলায় ঢেকে যাওয়া নগরের মুখ। এই প্রদর্শনী BMSS জাতীয় সম্মেলনের অন্যতম আলোচিত অংশে পরিণত হয়, যেখানে শতাধিক শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন।
Prosshash-এর প্রতিটি ধাপ আমরা ছড়িয়ে দিই ডিজিটাল মাধ্যমে—ফেসবুক রিলস, ডিজিটাল ক্যাম্পেইন, নির্মাণশ্রমিকদের গল্প এবং গ্রাফিক্সের মাধ্যমে। জাতীয় দৈনিকে রিপোর্ট ও ফিচার প্রকাশিত হয়, যা প্রকল্পটিকে আরও বৃহৎ পরিসরে পৌঁছে দেয়। Prosshash প্রমাণ করে—যদি মাঠের অভিজ্ঞতা, গবেষণা এবং সংবেদনশীলতা একত্রে কাজ করে, তাহলে একটি শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন প্রকল্পও হতে পারে নীতিগত পরিবর্তনের হাতিয়ার।
এই প্রকল্প শুধু গাছ লাগানো বা ছবি তোলার জন্য ছিল না—এটি ছিল ঢাকার মতো একটি শ্বাসরুদ্ধ শহরে নতুন করে নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রয়াস। এক শ্রমিক বলেছিলেন, “আমরা শহর বানাই, কিন্তু নিজেই ঠিকমতো নিশ্বাস নিতে পারি না।” Prosshash সেই কণ্ঠস্বরকে শহরের কানে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। Prosshash: Breathing Life into Dhaka প্রমাণ করে—পরিবর্তনের শুরু হতে পারে কয়েকজন তরুণের বিশ্বাস থেকে। আজ আমরা হয়তো এই শহরের এক কোণায় কিছুটা অক্সিজেন ফিরিয়ে দিতে পেরেছি, তবে আশা করি, আগামীকাল এই মডেল ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে। সবুজের জন্য লড়াই এখানেই শেষ নয়—এই তো শুরু।
লিখেছেন:
নিশাদ তাসনিম
প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, Prosshash: Breathing Life into Dhaka | বাংলাদেশ মেডিকেল স্টুডেন্টস’ সোসাইটি (BMSS)
আরও পড়ুন