সোমবার (২০ জানুয়ারি) ‘জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ সপ্তাহ ২০২৫’ উপলক্ষে বিএসএমএমইউয়ে সচেতনামূলক অনুষ্ঠান
দেশে নারীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো জরায়ু-মুখ ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সার। নিয়মিত পরীক্ষা ও ভ্যাকসিন নেয়ার মাধ্যমে এই মরণব্যাধি প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার। সোমবার (২০ জানুয়ারি) ‘জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ সপ্তাহ ২০২৫’ উপলক্ষে বিএসএমএমইউয়ে সচেতনামূলক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ কথা বলেন তিনি।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকালে র্যালি ও বহির্বিভাগে মাসব্যাপী সচেতনতামূলক সেবাবুথের উদ্বোধন করা হয়। র্যালিটি বি ব্লকের সামনে বটতলা থেকে বের হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশ প্রদক্ষিণ করে। এসব কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএসএমএমইউ সম্মানিত কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার। এ সময় এস্টাবলিশমেন্ট অব ন্যাশনাল সেন্টার ফর সার্ভিক্যাল এন্ড ব্রেষ্ট ক্যান্সার স্ক্রীনিং এন্ড ট্রেনিং এ্যাট বিএসএমএমইউ প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা, গাইনোকলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শিরিন আক্তার বেগম, অধ্যাপক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস, অধ্যাপক ডা. ফওজিয়া হোসেন প্রমুখসহ অবস এন্ড গাইনি বিভাগ, ফিটোম্যাটানাল মেডিসিন বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, চিকিৎসক, শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার বলেন, স্তন ক্যান্সার ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সার পরীক্ষা ও ভ্যাকসিন নেয়ার মাধ্যমে এই মরণব্যাধি প্রতিরোধ করা সম্ভব। স্তন ক্যান্সার পরীক্ষার জন্য সিবিই, জরায়ু-মুখ ক্যান্সার পরীক্ষার জন্য ভায়া টেস্ট করা অত্যন্ত জরুরি। সাথে সাথে জরায়ু-মুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে মহিলাদের ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
অন্য বক্তারা জানান, বিশ্বে মহিলাদের যত ধরনের ক্যান্সার হয় তার মধ্যে জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার অন্যতম। জরায়ু-মুখ ক্যান্সার বিশ্বজুড়ে মহিলাদের ক্যান্সারের মধ্যে চতুর্থতম এবং ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর চতুর্থতম শীর্ষ কারণ। এছাড়া, স্তন ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী এবং বাংলাদেশে উভয় ক্ষেত্রেই শীর্ষস্থানীয় ক্যান্সার। বাংলাদেশে মহিলাদের মৃত্যুর প্রধানতম দুটি কারণ হল জরায়ু-মুখ ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সার। এই দুটি ক্যান্সার গুরুত্বপূর্ণ নন-কমিউনিকেবল ডিজিসেস হিসেবে বিবেচিত।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর নতুনভাবে প্রায় ৮,২৬৮ জন মহিলা জরায়ু-মুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং ৪৯৭১ জন মহিলা মারা যায়। একইভাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর নতুনভাবে প্রায় ১৩০২৮ জন মহিলা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং ৬৭৮৩ জন মহিলা মারা যায়। জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর বেঁচে থাকা অনেকাংশে নির্ভর করে, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় ও কার্যকরী চিকিৎসা প্রদানের উপর। দেরীতে রোগ সনাক্তকরণ হলে সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা দেয়া কঠিন বিধায় মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই এসব রোগের চিকিৎসা সুবিধা সীমিত ও ব্যয়বহুল। প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার সনাক্ত করা গেলে মৃত্যু সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।
অনুষ্ঠানে আরও জানানো হয়, মহিলাদের মধ্যে প্রতিবছর নতুনভাবে জরায়ু-মুখ ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত মহিলাদের হার যথাক্রমে প্রতি লাখে ১২ ও ১৯ জন। যেহেতু, প্রতি বছর জরায়ু-মুখ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করছে ৫২১৪ জন এবং স্তন ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করছে ৬৮৪৬ জন মহিলা। এছাড়া, অন্তত ২-৩ শতাংশ ত্রিশোর্ধ মহিলা ক্যান্সারপূর্ব অবস্থায় আছেন। বর্তমানে ত্রিশোর্ধ বয়সী মহিলা রয়েছেন প্রায় ৩,২৭,৫০,০০০ জন। এ হিসাবে বাংলাদেশে অন্তত ৬,৫৫,০০০ থেকে ৯,৮২,৫০০ জন মহিলা ক্যান্সারপূর্ব/ক্যান্সার অবস্থায় আছেন। জরায়ু-মুখ ক্যান্সার কমানোর জন্য ক্যান্সার পূর্বাবস্থা/ক্যান্সার আক্রান্ত মহিলাদের খুঁজে বের করে তাদের চিকিৎসা দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জাতীয় পর্যায়ে জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ কর্মসূচি:
বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সাল হতে মহিলাদের জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সারের মৃত্যুহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছেন এবং সারা বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০টি সেবা কেন্দ্রে (বিএসএমএমইউ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ও হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, নির্বাচিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে) বিনামূল্যে জরায়ু-মুখ এবং স্তন ক্যান্সার স্ক্রীনিং সেবা চালু করতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়াও, সরকার দেশের ৩৭টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিএসএমএমইউ-এ জরায়ু-মুখ ক্যান্সার নিশ্চিতরূপে নির্ণয়ের নির্ণয়ের জন্য কল্পোস্কোপি পরীক্ষা ও এসংক্রান্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। দেশের প্রতিটি জেলায় তিন থেকে চারটি সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স ও মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীগণ নিয়মিত জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রীনিং ও এসংক্রান্ত তথ্য প্রদান করছেন। জরায়ু-মুখ স্ক্রীনিংকৃত মহিলাকে একইসময়ে সিবিই পরীক্ষার জন্য কাউন্সিলিং করা হয়। ত্রিশ বছরের অধিক বয়সী সকল মহিলাদের ভায়া ও সিবিই সেবা প্রদান করা হয় এবং সিবিই স্ক্রীনিংকৃত মহিলাদেরকে কিভাবে নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা (SBE) করতে হয় তা শিখিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার ৩০-৬০ বছর বয়সী বিবাহিত সকল মহিলাদের প্রতি তিন বছর পর পর ভায়া পরীক্ষা বিনামূল্যে ব্যবস্থা করেছেন।
বিএসএমএমইউ-এ কার্যক্রমে কারিগরী সহায়তা প্রদান করেছে। সরকার ২০০৫ সালে বিদ্যমান স্বাস্থ্য অবকাঠামোর ১৬টি জেলায় (জেলা হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে) ভায়া পদ্ধতির সম্ভাব্যতা যাচাই (feasibility assessment) এর জন্য একটি পাইলট কর্মসূচি পরিচালনা ও মূল্যায়ন করেছেন। এছাড়া, মহিলাদের স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ে সরকারি স্বাস্থ্য সেবায় ক্লিনিক্যাল ব্রেষ্ট পরীক্ষা (CBE) ও নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা (SBE) সম্পৃক্ত ও সংযোজন করার জন্য ২০০৬-২০০৭ সালে ভায়া কার্যক্রমভুক্ত একই এলাকার ১৬টি জেলায় পাইলট কর্মসূচি পরিচালনা করেছেন। সফল পাইলট কর্মসূচি’র মাধ্যমে সরকার স্বাস্থ্য সেবায় জরায়ু-মুখ ক্যান্সার প্রতিরোধের স্ক্রীনিং মাধ্যম হিসেবে VIA (Visual Inspection of Cervix with Acetic Acid) এবং স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের স্ক্রীনিং মাধ্যম হিসেবে CBE (Clinical Breast Examination) সংযোজন করেছেন। পর্যায়ক্রমে, সরকার অবশিষ্ট ৪৮টি জেলায় (মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র) জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রীনিং কর্মসূচি সম্প্রসারিত করেছেন। সরকার দেশের মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে এবং তৃণমূল পর্যায়ে মহিলাদের ক্যান্সার, মাতৃস্বাস্থ্য এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সারের মৃত্যুহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে জানুয়ারি ২০১২ হতে জুন ২০১৮ মেয়াদে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিএসএমএমইউ-এ ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ন্যাশনাল সেন্টার ফর সার্ভিক্যাল এন্ড ব্রেষ্ট ক্যান্সার স্ক্রীনিং এন্ড ট্রেনিং এ্যাট বিএসএমএমএমইউ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। প্রকল্পের মাধ্যমে (১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজি ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় ১৯৯৭০ বর্গফুট জায়গায় প্রয়োজনীয় অফিস ইকুইপমেন্টস ও লজিস্টিকসহ একটি পূর্ণাঙ্গ ‘জাতীয় জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রীনিং এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ নির্মিত হয়েছে; (২) সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ২২৮১ জন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য কর্মীর ব্যবস্থা করা হয়েছে; (৩) নির্বাচিত ২০০টি উপজেলায় সার্ভিক্যাল এন্ড ব্রেষ্ট ক্যান্সার স্ক্রীনিংয়ের সেবা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে; (৪) রেফারাল সেন্টার হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ১৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কল্পোস্কোপি ক্লিনিক স্থাপন (স্ক্রীনিং, কল্পোস্কোপি ও চিকিৎসা) করা হয়েছে এবং ব্রেষ্ট ক্যান্সার স্ক্রীনিং ও ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি ৩টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্রেষ্ট ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে; (৫) জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সেমিনার এন্ড কনফারেন্স এবং ভায়া সিবিই ক্যাম্প সম্পন্ন করা হয়েছে; (৬) এছাড়া, সারভাইক্যাল এন্ড ব্রেষ্ট ক্যান্সার স্ক্রীনিং কর্মসূচি উন্নয়নে বিজিবি হাসপাতাল/সিএমএইচ এবং কিছু প্রাইভেট হাসপাতাল সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
আরও পড়ুন