Advertisement
Doctor TV

বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫


‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সীমিত নয়’ ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

Main Image

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুহাম্মদ নুরুল হুদা খান ও তাঁর সহকর্মীরা


‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সীমিত নয়’ ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বর্তমানে বিশেষজ্ঞ ও শল্য চিকিৎসাও নিয়মিত পাচ্ছেন এখানকার রোগীরা। ডক্টর টিভিকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ নুরুল হুদা খান। সাক্ষাৎকার গ্রহন করেছেন সিনিয়র প্রতিবেদক ইলিয়াস হোসেন। পাঠকদের জন্য তার চুম্বক অংশটি তুলে ধরা হলো।   

 

ডক্টর টিভি : আপনার উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কিছু বলুন

ডা. মুহাম্মদ নুরুল হুদা খান : আমার হাসপাতালটি একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। যা সরকারের স্বাস্থ্য শিকলে একটি প্রাথমিক সেবা কেন্দ্র। কিন্তু আমি মনে করি, এটি কোনভাবেই প্রাথমিক শব্দের মধ্যে সীমিত নয়। বর্তমানে এখানে প্রায় সকল বিষয়ের বিশেষজ্ঞ সেবা চালু আছে। বাকি ছিল যে ব্যাপারটি- সেই শল্য চিকিৎসাও চালু করতে পেরেছি।

জরুরি বিভাগ ও অন্তঃবিভাগের সেবা শর্ত-মর্ত্য-অর্থ্য নির্বিশেষে চালু থাকে, হোক ঈদের নামায বা সেহরি বা ভূমিকম্পের সময়।


বহির্বিভাগে প্রায় শতভাগ ঔষধ দেবার চেস্টা করা হয়।


কোভিড ও অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির রোগীদের চিকিৎসা ও টিকা প্রদান নিয়মিত চলছে।


শিশু, নারী, পুরুষ, প্রসব, ডায়রিয়া, অপুষ্টি, দীর্ঘমেয়াদী রোগ… ইত্যাদি ব্যাপারে পৃথক পৃথক শয্যা ও ওয়ার্ড-কেবিনের সুবন্দোবস্ত আছে।


সমাজের পশ্চাৎপদগোষ্ঠী, কিশোর-কিশোরী, তৃতীয় লিঙ্গ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা গুরুত্বারোপ করা আছে।


বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সর্বোচ্চ যত্ন ও আন্তরিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা আছে।


বহির্বিভাগে অপেক্ষারত রোগীদের আলো বাতাস, আসন ও ডিজিটাল স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদর্শনীর আয়োজন করা আছে।


৫০ শয্যার উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল হলেও বারান্দা বা মেঝেতেও ভর্তি রোগীদের চাপ নিত্যই লক্ষ্য করা যায়। কেননা বিশেষজ্ঞ ও গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকগন যথেস্ট দক্ষ এবং আন্তরিক সেবার সাপোর্ট দিয়ে আস্থা তৈরি করেছেন।


কোন প্রজেক্ট সাপোর্ট না থাকা সত্ত্বেও মাসিক স্বাভাবিক প্রসবের সংখ্যা আমার সময় রেকর্ড ছাড়িয়ে দেড়শতেও গিয়েছে কখনো।


এমনকি আগের দু’বারের সিজারের রোগীকে একাধিকবার স্বাভাবিক প্রসব করাতে পেরেছি। যা সমকাল, প্রথম আলোসহ একাধিক জাতীয় প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।


ডক্টর টিভি : আপনি দায়িত্ব নেওয়ার নতুন কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?


ডা. মুহাম্মদ নুরুল হুদা খান : আমি ২০২০ সালের ১লা জানুয়ারি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করি। সেই সময় থেকে অনেকগুলো অনুষঙ্গের অবতারনা করেছি যা অত্র এলাকার স্বাস্থ্যসেবার ভাগ্যে নতুন ছিল। বিশ্বের পরিবর্তিত করোনা পরিস্থিতি ও সরকার বাহাদুরের ঐকান্তিকতায় যা নীতিমালাগুলোতে একীভূত।

২০২০ থেকেই প্রথম শুরু হয় হাসপাতালের নিজেস্ব চাহিদাভিত্তিক ক্রয় পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করি। এরপর হাসপাতাল ও হাসপাতাল চত্বরের পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করি। হাসপাতাল চত্বরে পরিত্যক্ত, নোংরা এবং জঙ্গল স্বরূপ জায়গা পরিষ্কার করে দু'টি বাগান নির্মাণ করি।


আমার পদের জন্য একটি গাড়িকে সংস্থান করতে পারা, হাসপাতাল ও আবাসিক নিরাপত্তার স্বার্থে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ক্যামেরা স্থাপন, ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণার, করোনার জন্য পৃথক সব ব্যবস্থাপনা ছাড়াও আল্ট্রাসোনোগ্রাম, ইসিজি, এক্সরে এনালাইজারসহ ১৫ রকম পরীক্ষার সুবন্দোবস্ত প্রথমবারের মত করতে পেরে গর্বিত বোধ করছি। বহির্বিভাগে সেবাগ্রহণকারী রোগীর সংখ্যা আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।


ভর্তি রোগীদের খাবারের মান বিশেষভাবে উন্নত করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে মুখরোচক উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। যা আমি প্রায়শই নিজে তদারকি করে থাকি।


ইউনিয়ন পর্যায়ে কোভিড টিকাদান কর্মসূচি আরো বেগবান এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভ্রাম্যমাণ টিকাদান কর্মসূচির আয়োজন করেছি।

হাসপাতালের আসবাব, বৈদ্যুতিক বিভিন্ন সরঞ্জামাদির যথেস্ট ব্যবস্থা করা, আবাসিক এলাকার যথাসাধ্য মানোন্নয়ন- যা আগে কখনো এভাবে হয়নি। 


বলা যায়- দীর্ঘ ১৭ বছর পর আমি প্রথম উপজেলা স্বাস্থ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা যিনি সাধ্য থাকা সত্ত্বেও হাসপাতাল চত্বরে বসবাস করছি। ফলে বিভিন্ন অপতৎপর চক্রের বিরাগভাজনও হতে হয়।


এরপর থেকে হাসপাতালের বেশ কয়েকটি রেকর্ড প্রতিস্থাপিত হয়। সেগুলো হলো-  স্বাভাবিক প্রসব সংখ্যা, সরকারের রাজস্ব তহবিলে ইউজার ফি/চালান, রোগীর সেবাদান পরিমান ও মান, যক্ষ্মা ও অন্যান্য টিকা ব্যবস্থাপনা। শুধু চক্ষু বাদে প্রায় সকল বিশেষজ্ঞ সার্ভিস চালু করা, অন্যান্য প্রখর চিকিৎসকের ও মানসম্পন্ন সেবিকাগন পর্যাপ্ত সমন্বয়করণ প্রভৃতি সকল পূর্ব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।


আমার জন্য সর্বোচ্চ চ্যালেঞ্জ ছিল- কখনোই চালু না হয় শল্য চিকিৎসা বা ওটি চালুর। শুধু ওটি রুম বাদ দিয়ে কিছুই এসে পাইনি।


ওটি টেবিল, লাইট, ডায়াথার্মি, জিএ মেশিন, সাকার, সিস্টেম সব যেন প্রায় শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। এখন শুধুমাত্র বিকল্প বিদ্যুতের দুর্যোগ চলছে।


মাননীয় সাংসদ ফখরুল ইমাম মহোদয় ও অত্র এলাকার অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের আগ্রহের মাধ্যমে এটি সম্ভবপর হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ যে, তার পুরোধী নেতৃত্বের নির্যাসের বলে যা আপাত: সম্ভব নয়- তা করতেও আমরা পিছপা হচ্ছিনা। এজন্য আশেপাশের বহু স্বার্থান্বেষী মহলের ক্রমান্বয়িক ষড়যন্ত্র, কটুক্তি ও শত্রুতাকে বরাবরই নিকুচি করেছি।


ডক্টর টিভি : এই এলাকার স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে কোন কোন বিষয় বিশেষ জরুরি?


ডা. মুহাম্মদ নুরুল হুদা খান : এই এলাকার মানুষের শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে একটি এম্বুল্যান্স এবং ডিজিটাল এক্সরে মেশিন অনতিবিলম্বে জরুরি। চক্ষু, সার্জারী ও নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট পদায়ন খুবই জরুরি। আমার প্রচেষ্টা থাকবে যেনে একজন মানুষও স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়।


ডক্টর টিভি : সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এই এলাকার মানুষের মনোভাব কেমন?


ডা. মুহাম্মদ নুরুল হুদা খান : আলহামদুলিল্লাহ! শুধু মাত্র ঈশ্বরগঞ্জ নয় আশপাশের ৩টি উপজেলার মানুষের সুচিকিৎসার বাতিঘর এখন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তারা এখানে এসে ভালো মানের সেবা পাচ্ছেন। আগের মতো আর শুধু ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে না সাধারণ মানুষকে। তবুও আরো অনেক জায়গায় উন্নতির সুযোগ রয়েছে। আমি এবং আমার টিম সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।


ডক্টর টিভি : আপনার হাসপাতালে কতটি পদ রয়েছে, এর মধ্যে পদ খালি আছে কতটুকু? শূন্যপদের চিকিৎসকদের অভাব কিভাবে পূরণ করছেন?

ডা. মুহাম্মদ নুরুল হুদা খান : আমার হাসপাতালে বিশেষজ্ঞের ৩টি পদ শূন্য রয়েছে- চক্ষু, নাক কান গলা ও সার্জারি। মেডিকেল অফিসার বা সহকারি সার্জনদেরও ৩টি পদ খালি রয়েছে। উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ২টি চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে।


এছাড়া ৩য়, ৪র্থ শ্রেনীর বিভিন্ন পদে অনেক বেশি শূন্যস্থান রয়েছে- বিশেষত:  পরিচ্ছন্ন কর্মী, ভান্ডার রক্ষক, পরিসংখ্যানবিদ, অফিস সহকারী। সুস্ঠু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এসকল পদের গুরুত্ব ‌অপরিসীম ।


ডক্টর টিভি : আপনার হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী ও কুকুরে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ সুবিধা কেমন?

ডা. মুহাম্মদ নুরুল হুদা খান : সাধারন বা বিষহীন সাঁপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা আমরাই দিয়ে থাকি। বিষাক্ত সর্পবিষের প্রতিরোধী ঔষধ আপাতত নেই, কিছু মেয়াদোত্তীর্ন।

কুকরে কামড়ানো রোগীর ঔষধ গত তিন বছরে বরাদ্দ পাইনি, তবে সম্প্রতি আশ্বাস পেয়েছি।


ডক্টর টিভি : আপনার হাসপাতালে কোন রোগী বেশি আসে?

ডা. মুহাম্মদ নুরুল হুদা খান : হাসাপাতালে দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত রোগী, প্রসূতি রোগী, শিশু রোগী বরাবরই বেশি আসে।  


ডক্টর টিভি : দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনও কোনো ধরনের প্রতিকূলতার সম্মূখীন হয়েছেন কিনা? হয়ে থাকলে কীভাবে তা মোকাবেলা করেছেন?

ডা. মুহাম্মদ নুরুল হুদা খান : একটি সুন্দর এবং যৌক্তিক  কথা আছে- যে কর্মকর্তার কাজে শতভাগ জনগন শতভাগ  খুশী বা যার একজনও সমালোচক নেই- তিনি আসলে দক্ষ বা নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নন। আমরা কাজ করি দুটো বিষয়ের আলোকে- বিজ্ঞান (চিকিৎসা) ও আইন (সরকারি)। এ দুটোতেই সমন্বয় করতে গিয়ে কখনো কখনো কারো কারো, তিনি সাধারন জনগন হোক বা জনপ্রতিনিধি, বিরাগভাজন অবশ্যই হতে হয়েছে। আমাকে বদলির জন্য অনেকেই উঠে পড়ে লেগেছেন। তাতে আমি বিচলিত হইনি। বরং মনে করেছি, আমি সঠিক পথেই আছি।


জনগনের চিকিৎসা ব্যবস্থা,পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ঔষধ এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক মাঠের যেকোন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে গিয়ে অসাধু মানুষ বা চক্রের পাঁয়তারা থাকবেই। কারোই তাতে বিচলিত হওয়া উচিত নয়, আমরা বদলির চাকুরি করি ৩-৫ বছর মেয়াদে। একজন পিয়নেরও উচিত নয়- একই জায়গায় এর চেয়ে বেশি সময় থাকা।

 

ডক্টর টিভি : দেশের চিকিৎসকদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?


ডা. মুহাম্মদ নুরুল হুদা খান :  দেশের চিকিৎসক কিছুটা হতাশ, কেননা তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য কঠিনেও অর্জিত হচ্ছে না। বেকারত্ব আছে। পাশাপাশি ভাল কাজ করলেও প্রশংসার ব্যাপারটি যেন আমাদের মধ্যে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

তবু বলবো- আমাদের জাতির পিতার একটি লাইন, ”কে বানায় ডাক্তার সাব, কে বানায় চ্যায়ারম্যান সাব, কে বানায় সচিব সাব? আমার জনগন।”

সুস্থ হয়ে যাওয়া মানুষের ভেতরের যে দোয়া- তা কখনো মূল্য দেয়া শোধ করা যাবেনা । নিজ কাজ বুঝা ও করাকেই দেশপ্রেম বলে।

আরও পড়ুন