সময়মতো চিকিৎসা না করালে উচ্চ রক্তচাপের পরিণতি মারাত্মক

অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন
2021-04-28 09:09:03
সময়মতো চিকিৎসা না করালে উচ্চ রক্তচাপের পরিণতি মারাত্মক

সময়মতো চিকিৎসা না করালে উচ্চ রক্তচাপের পরিণতি মারাত্মক

আমাদের শরীরে যে রক্তনালী আছে, সেখানে সবসময় রক্ত প্রবাহিত হয় একটা নির্দিষ্ট চাপের মাধ্যমে। এই নির্দিষ্ট চাপের একটা স্বাভাবিক মাত্রা আছে। সেটাই হলো স্বাভাবিক রক্তচাপ। আর কোনো ব্যক্তির এই রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার থেকে বেশি থাকলে তাকে  বা হাইপারটেনশন বলে।

রক্তচাপ সবসময় একই রকম থাকে না। এটা পরিবর্তন হয়। একটা নির্দিষ্ট মাত্রার ভেতর থাকলে আমরা সেটাকে স্বাভাবিক বলি। সাধারণত ইন্টারন্যশনাল সোসাইটি অব হাইপারটেনশনের মতে, স্বাভাবিক মাত্রা বলা হয় সিস্টোলিক ১৩০ মিলিমিটার মার্কারির নিচে। আর ডায়াস্টোলিক ৮০ মিলিমিটার মার্কারি অথবা তার কম।

আর সিস্টোলিক ১৩১-১৩৯ অথবা ডায়াস্টোলিক ৮১-৮৯ হলে সেটাকে বলা হয় হাই নরমাল। এরপরে ‘গ্রেড ওয়ান’ আর ‘গ্রেড টু’। গ্রেড ওয়ান হল- সিস্টোলিক ১৪০-১৫৯ আর ডায়াস্টোলিক ৯০-৯৯ মিলিমিটার মার্কারি। এই দু’টি বা যেকোন একটি এই মাত্রার ভেতর আসলেই তাকে আমরা বলবো ‘গ্রেড ওয়ান’। ‘গ্রেড টু’ হলো সিস্টোলিক ১৬০ বা এর বেশি আর ডায়াস্টোলিক ১০০ বা এর এর বেশি।

ব্যায়ামের পরে বা বিভিন্ন দুশ্চিন্তা থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি থাকে রক্তচাপ। এটাকে কখনো উচ্চ রক্তচাপ বলবো না। কারণ সংজ্ঞাতে বলা হয়েছে, রক্তচাপ সবসময় স্বাভাবিক মাত্রার থেকে বেশি থাকে। এখন হঠাৎ করে দুশ্চিন্তায় পড়া বা শরীরচর্চার কারণে রক্তচাপ বাড়তে পারে। কিন্তু এটা সবসময় না, সাময়িক। তাই এটা উচ্চ রক্তচাপ নয়।

সাধারণত অনেক সময় রক্তচাপ স্বভাবিক কিন্তু চিকিৎসকের কাছে গেলে দুশ্চিন্তার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। এটাকে আমরা বলি হোয়াইটকোট হাইপারটেনশন। আমাদের সমাজে যত হাইপারটেনশন রোগী আছেন, তাদের ভেতর ৫০ থেকে ৩০ ভাগ হোয়াইটকোট হাইপারটেনশন। এক্ষেত্রে আমরা তাদেরকে বলব রক্তচাপ স্বভাবিক।

২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উচ্চ রক্তচাপকে নিরব ঘাতক হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। বয়স যত বাড়তে থাকে, উচ্চ রক্তচাপের মাত্রা তত বাড়তে থাকে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৬০ বছর বয়সের ওপরের ৬০ ভাগ মানুষের হাইপারটেনশন এবং ৮০ বছর বয়সের ওপরের ৮০ ভাগ মানুষের হাইপারটেনশন। আর একটি হলো নারীদের থেকেও পুরুষের উচ্চ রক্তচাপ বেশি থাকে।

বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলে সন্তানেরও সেটা হওয়ার সম্ভাবনাটা বেশি। এছাড়া কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় আছে। যেমন- কায়িক পরিশ্রম না করা, মাদকদ্রব্য সেবন করা। এর ফলে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ দুই প্রকার। ১. এসেনশিয়াল হাইপারটেনশন ২। সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন।

সেকেন্ডারি হাইপারটেনশনের সংখ্যা ৫ ভাগ এবং এখানে নির্দিষ্ট কারণ আছে। এই কারণ যদি নির্ধারণ করতে পারি তাহলে সেখানে উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্ত ৯০ বা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে কারণ জানা যায় না। এদেরকে বলা হয় প্রাইমারি হাইপারটেনশন।

একজন ৫৮ বছরের হার্ট ফেলিওর নারী রোগীর রক্তচাপের জন্য এনজিলক ৫০ খান শুধু রাতে। কিন্তু মাঝে মাঝে তার রক্তচাপ অনেক বেড়ে যায়। এখন এনজিলক ৫০ খেয়েও উচ্চ রক্তচাপ হয়তো কম হচ্ছে না। এখানে দেখতে হবে ওই নারীর হাইপারটেনশনের অরগান নষ্ট আছে কি না। সেক্ষেত্রে তার উচিৎ হবে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা বা ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে নেওয়া অথবা অন্য আর একটি ওষুধ যুক্ত করে নেওয়া।

অনেক সময় হাইপারটেনশনের রোগী রক্তচাপ একটু কম থাকলে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করে দেন। হাইপারটেনশনের চিকিৎসা দুই ধরনের। একটা হলো ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা আর একটি হল ওষুধ ছাড়া চিকিৎসা। ওষুধ ছাড়া চিকিৎসাটা হলো শুধু নিয়ন্ত্রিত জীবন ব্যবস্থার ভেতর। এখানে নিজে নিজের ওজনটা নিয়ন্ত্রিত রাখা, সুষম খাবার গ্রহণ করা, ধুমপান বা অ্যালকোহল গ্রহণ না করা, পরিমিত শরীরচর্চা করা এবং রাতে পর্যাপ্ত ঘুম। এরপরও কাজ না হলে, চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।

সাধারণত ওষুধ একবার গ্রহণ করলে সারাজীবন নিতে হয়, এটা সবসময় সত্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ বন্ধ করা যায়, কিন্তু সেটা রোগীর ইচ্ছা মতো নয়, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে করতে হবে।

অনেকে মনে করেন উচ্চ রক্তচাপটা বয়স্কদের সমস্যা। কিন্তু এখন দেখা যায়, কমবয়সীদেরও উচ্চ রক্তচাপের পরিমাণ দিনদিন বাড়ছে। এটি হতে পারে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন, যেটা যুবক বয়সে বেশি হয়।

উচ্চ রক্তচাপে রোগীর চিকিৎসা

উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে যখন রোগীদের ওষুধ দেওয়ার আগে আমরা প্রথমে রোগীর রক্তচাপের পরিমাপ করার চেষ্টা করবো। তারপর তার অন্য কোনো রোগ আছে কিনা সেটা দেখার চেষ্টা করবো। যেমন- ডায়াবেটিস বা অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি দেখার পরে, আমরা সঠিক ওষুধ নির্ধারণ করবো। ওষুধের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের বাইরে অন্য কোনো রোগ থাকলে রোগীভেদে একেক রকম ওষুধ দেওয়া হয়।

রোগী ওষুধ নির্ভর হয়ে গেলে অনেক সময় তিনি মনে করেন, আমি তো ওষুধ খাচ্ছি। সেক্ষেত্রে তিনি নিয়ন্ত্রিত জীবন ব্যবস্থাকে অতটা গুরুত্ব দেন না। রোগীদের একটা চাহিদা বা দাবি, আপনাদের এত পরামর্শ আমি গ্রহণ করতে রাজি নই। আমি আপনার কাছে আসছি; আপনি ওষুধ লিখে দেন, আমি ভালো থাকতে চাই। এখানে নিয়ন্ত্রিত জীবন ব্যবস্থার গুরুত্ব আমাদের ভেতর প্রচলিত নেই। এর জন্য আমাদের সামাজিকভাবে, সরকারিভাবে এবং মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার।

উচ্চ রক্তচাপ বেশিরভাগ সময় কমিয়ে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। তবে অনেকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে পারছেন না। কেউ কেউ মনে করেন, আমার তো কোনো লক্ষণ নাই। আবার কেউ বলেন, চিকিৎসকের কাছে যেতে ভালো লাগছে না, রাস্তাঘাট ভালো না, যাতায়াত খরচ ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে তারা চিকিৎসকের কাছে যান না। কিন্তু এর ফলে দুই বছর, তিন বছর বা পাঁচ বছর পরে টার্গেট অর্গান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে স্ট্রোক, হার্ট নষ্ট, হার্ট অ্যাটাক বা কিডনি নষ্ট, এমনকি অন্ধত্ব বা রক্তনালী পচন ধরতে পারে। তখন চিকিৎসকের করার কিছুই থাকে না।

উচ্চ রক্তচাপ অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। উচ্চ রক্তচাপের ফলে স্ট্রোক, হার্ট নষ্ট বা হার্ট অ্যাটাক, কিডনি নষ্ট, অন্ধত্ব বা রক্তনালী পচন হয়। এটা সাধারণত ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সের ভেতর হয়। বর্তমানে একজন মানুষের গড় আয়ু যদি ৭২ বছর ধরি, প্রথম ৩০ বছর আমাদের পড়া-শুনা করতে যায়, এরপরের ১০ বছর যায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। এই ৪০ থেকে ৬০ বছর সময়ে আমরা নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য এবং দেশের জন্য কিছু করতে পারি। ঠিক এই সময় উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাটি দেখা দেয়।

এর ফলে আমি নিজেই নিজের কাছে বোঝা হয়ে গেলাম, পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে গেলাম। এর ফলে আমরা ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তাই আমরা উচ্চ রক্তচাপকে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেও অনেক উপকৃত হবো।

[প্রিয় চিকিৎসক, আপনিও ডক্টর টিভি অনলাইনের অংশ হয়ে উঠুন। স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা পরামর্শ, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার টিপসসহ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মতামত লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুন-mail.doctortv@gmail.com-এ ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে। এছাড়াও মেডিকেল শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সেমিনার, সংবর্ধনা অনুষ্ঠান, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নিউজ পাঠাতে পারেন। এছাড়াও কিংবদন্তি চিকিৎসকদের সাক্ষাৎকারও পাঠাতে পারেন। আপনাদের লেখা যত্নসহকারে প্রকাশ করা হবে।।]


আরও দেখুন: