ছবিঃ পিআইডি
দেশের স্বাস্থ্যখাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সরকার। এসব কার্যক্রমের সুফল আগামী দিনে জনগণ পাবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর শহীদ আবু সাঈদ আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে অন্তর্বর্তী সরকারের গত এক বছরে স্বাস্থ্যখাতের অর্জন এবং ভবিষ্যৎ সংস্কার পরিকল্পনা তুলে ধরতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারীসহ মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তারা।
আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন
নূরজাহান বেগম জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয় দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে চৌদ্দ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় এখন পর্যন্ত ১৩,৮১১ জন আহতের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, আর গেজেটে প্রকাশিত ভেরিফায়েড আহতের সংখ্যা ১২,০৪২ জন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সামাজিক ও গণমাধ্যমের সহায়তায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আহতদের তথ্য পাওয়া মাত্রই জেলা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে যাচাই করে তা এমআইএস সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এখন পর্যন্ত ৪০ জন জুলাই আহতকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছে এর মধ্যে থাইল্যান্ডে ২৬ জন, সিঙ্গাপুরে ১৩ জন এবং রাশিয়ায় ১ জন। এরা মূলত চোখ, অঙ্গহানি, মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত। এছাড়া ২৭ জুলাই পর্যন্ত মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশে ১০৪ জন আহতের তালিকা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩৮ জনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত দুই মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সর্বমোট ৭৮ জন আহত বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিয়েছেন।
দেশীয় চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ দক্ষতা প্রয়োগের পাশাপাশি বিশ্বের সাতটি দেশ সিঙ্গাপুর, নেপাল, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য ও থাইল্যান্ড—থেকে মোট ২৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন গুরুতর আহতের সফল সার্জারি সম্পন্ন করেছেন।
আহতদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে গেজেটভুক্ত ১২,০৪২ জন জুলাই যোদ্ধার মধ্যে ৭,৩৬৩ জনকে স্বাস্থ্য কার্ড প্রদান করা হয়েছে, যা আজীবন সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ দেবে। আহতদের খাদ্যতালিকার মানোন্নয়নে পথ্য খাতে জনপ্রতি বরাদ্দ ১৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০ টাকা করা হয়েছে।
রোবোটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার স্থাপন
পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও গুরুতর আহতদের উন্নতমানের ফিজিওথেরাপি দিতে চীনের সহায়তায় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক রোবোটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ রোগী চিকিৎসা পাবেন। সেন্টারটিতে ৬২টি উন্নত রোবোটিক থেরাপি ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে ২২টি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালিত হবে। এ উদ্যোগ শুধু জুলাই আহতদের জন্য নয়, অন্যান্য রোগীদের জন্যও উন্মুক্ত থাকবে।
চিকিৎসকদের পদোন্নতি ও নিয়োগ কার্যক্রম
চিকিৎসকদের পেশাগত মর্যাদা ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নের অংশ হিসেবে প্রায় ৭ হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথমবারের মতো সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে ব্যাপক পরিসরে পদোন্নতির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসককে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, পরিচালক ও জুনিয়র কনসালটেন্ট পদে উন্নীত করা হয়েছে। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) এর মাধ্যমে ৮৬টি বিষয়ে প্রায় ৮০০ চিকিৎসককে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শূন্যপদে পদোন্নতি সম্পন্নের পর আরও প্রায় ৬,০০০ চিকিৎসককে সুপার নিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে।
জনবল সংকট মোকাবিলায় নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুততর করা হয়েছে। ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে ৩,০০০ চিকিৎসক নিয়োগের জন্য পিএসসিতে সাক্ষাৎকার চলছে। এছাড়া ৪৫তম, ৪৬তম ও ৪৭তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে আরও ৩,৫০০-এর বেশি চিকিৎসক নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে ৩,৫১২ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সের নিয়োগ সম্পন্ন হয়ে পদায়নের কাজ চলছে, এবং আরও ৯০০ নার্সের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি ৫,০০০ নার্স ও ৪,০০০ মিডওয়াইফের জন্য নতুন পদ সৃষ্টি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
আইন সংস্কার ও নতুন হাসপাতাল নির্মাণ
নতুন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। “মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন অধ্যাদেশ, ২০২৫” উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে, যা শিগগিরই অধ্যাদেশ আকারে জারি হবে। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী নতুন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনও প্রণয়নাধীন।
চীনের অনুদানে রংপুর বিভাগে ১,০০০ শয্যার হাসপাতাল এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রামে ৫০০ থেকে ৭০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এডিবি’র অর্থায়নে স্বাস্থ্যখাতের ডিজিটালাইজেশন প্রকল্প অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সম্ভাব্য অর্থায়নে “ওয়ান হেলথ” প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাণী থেকে মানবদেহে ছড়ানো রোগ প্রতিরোধে কার্যকর হবে।
চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের দাম হ্রাস
হার্টের রিং ও স্টেন্টের দাম যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। স্টেন্টের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ ৫ শতাংশের বেশি নেওয়া যাবে না—এ মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ক্যান্সার প্রতিরোধী ওষুধ তৈরির জন্য আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রস্তাবনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দেশে সব ধরনের ই-সিগারেট পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে।
মাইলস্টোন স্কুল দুর্ঘটনা ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা
গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনায় সরকারি ও বেসরকারি আটটি হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও পাইলটসহ ৩৪ জন মারা গেছেন এবং বর্তমানে বার্ন ইনস্টিটিউটে ৩৪ জন ভর্তি আছেন। দেশীয় চিকিৎসকদের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, চীন ও ভারত থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এসে চিকিৎসা দিয়েছেন। যুক্তরাজ্য থেকেও একটি দল পাঠানোর আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক আঘাত প্রশমনে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে জরুরি হটলাইন, বিশেষ ‘আউটডোর সাইকিয়াট্রিক সেল’ এবং সংরক্ষিত বেড চালু করা হয়েছে। দ্রুত সময়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে, মাঠপর্যায়ে আউটরিচ কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস (বিএপি)-এর সহায়তায় সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তিন শিফটে হটলাইন সেবা চালু রাখা হয়েছে। কয়েকজন শিক্ষার্থী ইতোমধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন