Advertisement
Doctor TV

রবিবার, ২৫ মে, ২০২৫


জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের তথ্য ও ফল প্রকাশ বিএমইউতে

Main Image


বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, জরায়ুমুখ ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (এইচআর-এইচপিভি) সংক্রমণের হার এখনও তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও অঞ্চলভেদে এর পার্থক্য সুস্পষ্ট। এর হার সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৫৬ থেকে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। রোববার (২৫ মে) বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবু সাঈদ ইন্টারন্যাশাল কনভেনশন সেন্টারে ইলেকট্রনিক ডাটা ট্রাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং প্রকল্পের  তথ্য ও বিভিন্ন গবেষণার প্রকাশিত ফলাফলে এ তথ্য জানানো হয়েছে। 

 

এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে প্রকল্পের বিস্তার, অগ্রগতি, সফলতা, সম্ভাবনা, প্রতিবন্ধকতা জনসম্মুখে তুলে ধরা বিষয়ক তথ্য জানানো হয়। এই গবেষণাগুলোর ফলাফল বাংলাদেশের জরামুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের কার্যকর উন্নয়ন এবং নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা সরকার, স্বাস্থ্য পেশাজীবী ও স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে ভবিষ্যৎ স্ক্রিনিং কার্যক্রমকে আরও জোরদার করার আহ্বান জানান।

 

অনুষ্ঠানে উপকূলীয় এবং উচ্চ-প্রকোপযুক্ত অঞ্চলে (সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম) এইচআর-এইচপিভি স্ক্রিনিং চালু করা, গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে সমান গুরুত্ব দিয়ে স্ক্রিনিং সম্প্রসারণ, ৩৫-৪৪ বছর বয়সীদের অগ্রাধিকার, জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে সংযুক্ত ই-স্বাস্থ্য প্ল্যাটফর্মের উন্নয়ন, ভায়া+ এইচপিভি এর সম্মিলিত পদ্ধতির মাধ্যমে ট্রাইএজ এবং ফলো-আপ নিশ্চিতকরণ, ল্যাবরেটরি ও হিস্টোপ্যাথলজি রিপোর্টিং-কে ই-এইচআইএসের সাথে যুক্ত করা ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়। অনুষ্ঠানে সেরা কমিউনিটি ক্লিনিক, সেরা ভায়া ও সিবিই কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৪৬ জনকে পুরস্কৃত করা হয়।


বিএমইউ এর সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর-ই-ফেরদৌসের নেতৃত্বে উপকূলীয় অঞ্চলে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের তিনটি জেলায় (ঝালকাঠি, কক্সবাজার, বাগেরহাট) বিবাহিত ৯০০ জন মহিলার মধ্যে এইচআর-এইচপিভি সংক্রমণের হার ছিল ২.৫৬%, সংখ্যায় ২৬ জন। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ পাওয়া গেছে ঝালকাঠিতে (৩.০%)। সবচেয়ে বেশি পাওয়া জিনোটাইপ ছিল এইচপিভি ধরণ ১৬ (৩৮.৪৬%)। গবেষণাটি এই অঞ্চলে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে জিনোটাইপিং-ভিত্তিক স্ক্রিনিং প্রবর্তনের সুপারিশ করে।

 

বিএমইউ এর অধ্যাপক ডা. শিরিন আক্তার বেগমের নেতৃত্বে শহর বনাম গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে পরিচালিত ৩,৮৫৬ জন মহিলার উপর একটি বিশ্লেষণাত্মক গবেষণায় দেখা যায়, সামগ্রিকভাবে এইচআর-এইচপিভি সংক্রমণের হার ছিল ৩.৬%, সংখ্যায় ১ শত ৩৮ জন। সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল সিলেটে (৬.৪%) এবং সর্বনিম্ন রাজশাহীতে (১.৭%)। সিলেটের গ্রামীণ অঞ্চলে সংক্রমণ ছিল ৭.১%, যা শহরাঞ্চলের তুলনায় বেশি। গবেষণায় ৩৫-৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে সংক্রমণের হার সর্বাধিক পাওয়া যায়।

 

মুগদা মা ও শিশু হাসপাতালের ডা. জাকান্ত ফাইকার স্ক্রিনিং পদ্ধতির তুলনা বিষয়ক গবেষণায়, ৪৭৯২ জন মহিলাকে দুটি গ্রুপে ভাগ করে ভায়া + এইচপিভি এবং শুধুমাত্র এইচপিভি স্ক্রিনিং-এর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হয়। ভায়া + এইচপিভি পদ্ধতিতে ৫.৯% পজিটিভ পাওয়া গেলেও শুধুমাত্র এইচপিভি-তে এই হার ছিল ৩.৭%। একত্রিত পদ্ধতিতে রোগ সনাক্তকরণ ও ফলো-আপের হার বেশি ছিল, যা স্ক্রিনিং কার্যক্রমের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

 

বাংলাদেশের দুটি উপজেলায় জরায়ুমুখ ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি পরীক্ষা বিষয়ক একটি পাইলট গবেষণা পরিচালনা করেন ডা. আসমা আক্তার সোনিয়া। বাংলাদেশে জরায়ুমুখ ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ে জিনোটাইপ সহ উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি পরীক্ষার ভূমিকা চিহ্নিত করাই এর উদ্দেশ্য। প্রতিটি গবেষণা এলাকা থেকে ৩০-৬০ বছর বয়সী ১০,০০০ মহিলাদের নিয়ে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণার ফলাফলে  ৩.২%, সংখ্যায় ৩ শত ১৮ জন মহিলার এইচআর-এইচপিভি সংক্রমণ রয়েছে। সমস্ত মহিলাদের মধ্যে, ১%, সংখ্যায় ৯৭ জন মহিলার এইচপিভি ধরণ ১৬ এবং ০.২%, সংখ্যায় ২০ জন মহিলার এইচপিভি ধরণ ১৮ ছিল। এই গবেষণায় এইচআর-এইচপিভির প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে কম (৩.২%)। ভায়া এর তুলনায় এইচআর-এইচপিভি পরীক্ষা উচ্চ সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে বলে প্রমাণিত।

 

স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং বিষয়ে ডা. সাদিয়া রসুলের গবেষণায় ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন (সিবিই) এবং ম্যামোগ্রাফির সংমিশ্রণে স্তন ক্যান্সার সনাক্তকরণে উচ্চ সংবেদনশীলতা (৯৩.৩%) এবং নির্দিষ্টতা (৯৭.৬%) দেখা যায়, যা প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার সনাক্তকরণে সিবিই-এর গুরুত্ব নির্দেশ করে।

 

জাতীয় পর্যায়ে স্ক্রিনিং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিএমইউ এর অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসার নেতৃত্বে রাজশাহী বিভাগে ডিএইচআইএস২ ভিত্তিক একটি ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থার ই-এইচআইএস এর মাধ্যমে স্ক্রিনিং কার্যক্রম পরিচালনা ও মূল্যায়ন করা হয়েছে। এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত, দেশের ১৪,২১৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছে। এর মাধ্যমে স্ক্রিনিং, কলপোস্কোপি এবং ট্র্যাকিং-এর মধ্যে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। তবে, দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে। 

 

তিনি আরো জানান, জরায়ু ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য ৬০ লক্ষ ৯৩ হাজার ২ শত ২৪ জন মহিলার ভায়া পরীক্ষা করে ২,০৫,৩৫৮ জনের পজেটিভ পাওয়া যায় শতকরা হিসেবে এ হার ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশে লক্ষ্য মাত্রার ২১ শতাংশ মহিলাকে স্ক্রিনিং কর্মসূচীর আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।

 

দুটি পর্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রথম পর্বে গবেষণা সমূহের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। প্রথমপর্বে সভাপতিত্ব করেন বিএমইউর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার। দ্বিতীয় পর্বে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএমইউর ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএমআরসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা. নূরে আলম সিদ্দিকী। 

 

অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বিএমইউর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএমইউর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ। বাংলাদেশে জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং ও প্রতিরোধ কার্যক্রম বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন প্রকল্প পরিচালক (ইপিসিবিসিএসপি) অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা।

 

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী বলেন, মানুষের স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করতে ও চিকিৎসাসেবাকে মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে রাখতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা নির্ণয় করতে পারলে অনেক মায়ের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে। ইলেকট্রনিক ডাটা ট্রাকিংসহ  জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচীর কার্যক্রমে ধারবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।

 

ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, অপ্রতুল বাজেট ও প্রয়োজনীয় তুলনায় স্বল্প বাজেট দিয়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন স্বাস্থ্য কর্মসূচীতে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে। ইলেকট্রনিক ডাটা ট্রাকিংসহ  জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচীর আজকের অনুষ্ঠানটিও অসাধারণ। যেখানে স্বাস্থ্যখাতের তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ রয়েছেন। কমিউনিটি পর্যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অপূর্ব মেলবন্ধন আজকের আয়োজন। জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ, চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকরণ ও নারী স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে ইনস্টিটিউটে উন্নীত করা হবে। বিশেষ করে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ ব্লকের ৬ষ্ঠ, ১০ম ও ১১ তলা নিয়ে স্তন ক্যান্সার ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার নির্ণয়ে স্ক্রিনিং কার্যক্রম, চিকিৎসাসেবাসহ এ ধরনের রোগীদের সামগ্রিক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে একটি আলাদা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হবে।

আরও পড়ুন