সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস ইউনিটে একটি সভায় ‘ঢাকা শহরের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য স্বল্প খরচে টেকসই হাসপাতাল বর্জ্য পানি পরিশোধন ও পুনঃব্যবহার’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল উপস্থাপন করা হয়
সফলভাবে দেশের প্রথম কম খরচে টেকসই হাসপাতাল বর্জ্য পানি পরিশোধন প্লান্ট (ডব্লিউডব্লিউটিপি) স্থাপন ও পরিচালনা করেছে ঢাকার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ইন্টিগ্রেটেড হেলথ সায়েন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের অর্থায়নে নির্মিত এই উদ্ভাবনী প্লান্টটি বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা (ইসিআর) ২০২৩-এর নির্ধারিত বর্জ্য পানি নির্গমনের মানদণ্ড পূরণ করে। সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস ইউনিটে একটি সভায় ‘ঢাকা শহরের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য স্বল্প খরচে টেকসই হাসপাতাল বর্জ্য পানি পরিশোধন ও পুনঃব্যবহার’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল উপস্থাপনকালে এ তথ্য জানানো হয়।
এ সময় বলা হয়, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ২৪ কিলোলিটার পার ডে (কেএলডি) ক্ষমতাসম্পন্ন মেমব্রেন বায়োরিঅ্যাক্টর (এমবিআর) ভিত্তিক হাসপাতালের বর্জ্য পানি পরিশোধন প্লান্ট সফলভাবে চালু করা হয়েছে। এই আধুনিক ছয়-ধাপ বিশিষ্ট পরিশোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হাসপাতালের বর্জ্য পানি থেকে পুনঃব্যবহারযোগ্য পানি উৎপাদন করা হয়, যা বাগান পরিচর্যা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও অন্যান্য অ-পানীয় কাজে ব্যবহারের উপযোগী। কঠোর পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন যে প্লান্টটি শতভাগ সফলতার সঙ্গে হাসপাতালের বর্জ্য পানি থেকে মলের রোগজীবাণু (ই কোলাই), ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া (ইএসবিএল ই কোলাই), ভিব্রিও কলেরা, সালমোনেলা টাইফি অপসারণ করতে সক্ষম। পাশাপাশি, এটি রোটাভাইরাস এ-এর ৯৯ শতাংশ হ্রাস নিশ্চিত করেছে এবং বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩-এর মানদণ্ড সম্পূর্ণরূপে পূরণ করছে।
এই পরিশোধনাগারের নকশাটি সংক্ষিপ্ত, পরিচালন ব্যয় স্বল্প, এবং একজন অপারেটরের দ্বারা সহজে পরিচালনা করা যায় তাই এটি বাংলাদেশ ও অন্যান্য নিম্ন-আয়ের দেশের হাসপাতালগুলোর জন্য একটি টেকসই আদর্শ সমাধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এই প্রকল্পগুলো পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে গুরুতর প্রভাব ফেলে এবং এর জন্য ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক। তবে, ঢাকার কোনো হাসপাতালই এখনো দ্বিতীয় স্তরের পরিশোধন ব্যবস্থা বা কার্যকরী ইটিপি পরিচালনা করছে না। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩ অনুযায়ী ৫০ শয্যার বেশি হাসপাতালগুলিকে 'রেড' ক্যাটাগরি প্রকল্প হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।
অধিকাংশ হাসপাতাল এখনো সেপটিক ট্যাংক বা এনঅ্যারোবিক ব্যাফল রিঅ্যাক্টর-এর মতো পুরোনো ও অকার্যকর প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করছে, যা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্যের মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে, অপরিশোধিত বর্জ্যপানি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু, ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ বহন করে আশপাশের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এটি রোগ সংক্রমণ বৃদ্ধি ও পরিবেশগত ক্ষতির ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্টের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. জয়নাল আবেদিন টিটো এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, ‘এই প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকার, আইসিডিডিআর,বি এবং ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনি’র যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে। আশা করি এর মাধ্যমে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে, আমাদের পরিবেশে যে সব জীবাণু ব্যাপকভাবে ছড়ায়, মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্স তৈরি করে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এটা স্বল্প খরচের সহজ প্রযুক্তি হওয়ায় আশা করি বাংলাদেশের সব হাসপাতাল এটি ব্যবহার করতে পারবে এবং এর মাধ্যমে আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে।’
আইসিডিডিআর,বি’র এনভায়রনমেন্ট হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ ইউনিটের সহযোগী বিজ্ঞানী এবং গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ডা. মো. নুহু আমিন প্রকল্পটির ব্যাপক প্রভাব সম্পর্কে বলেন, ‘এই প্লান্টটি এখন আর পরীক্ষামূলক মডেল নয়-একটি প্রমাণিত, স্বল্প খরচে কার্যকর প্রযুক্তি যা বিপজ্জনক দূষণ উপাদান সম্পূর্ণরূপে অপসারণ করে পুনঃব্যবহারযোগ্য পানি উৎপাদন করতে সক্ষম। সফল বাস্তবায়নের পর এই মডেলটি দেশের অন্যান্য উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালগুলোতে সম্প্রসারণের জন্য প্রস্তুত, যা রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং পানি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক এবং বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য একটি দৃষ্টান্ত।’
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বুয়েটের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এই প্রমাণিত ও সহজ ব্যবস্থাটি একটি জাতীয়ভাবে সম্প্রসারণযোগ্য সমাধান। যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা এটি মূলধারায় নিয়ে আসতে পারি, যা দূষণ মোকাবেলা এবং দেশের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনির অধ্যাপক জুলিয়েট উইলেটস বলেন, ‘এই প্রকল্পটি বিশ্বব্যাপী নিম্ন সম্পদযুক্ত অঞ্চলের জন্য একটি দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ। হাসপাতালের অপরিশোধিত বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনায় এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত, এবং এর ছোট ও সহজ নকশা এটিকে অন্যান্য শহর ও দেশের জন্য সহজেই গ্রহণযোগ্য করে তোলে। স্থানীয় বিশেষজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বকে একত্রিত করে আমরা এই মডেলটি পুনরুৎপাদন করতে পারি, যা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেবে এবং স্বাস্থ্য ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করবে।’
সভায় নীতিনির্ধারক, অংশীদার এবং বিশেষজ্ঞরা গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করেন ও এই প্রযুক্তির বিস্তৃত বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করেন।
আরও পড়ুন