অতিরিক্ত ওজন ও ভেজাল খাদ্য স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়
ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার
মানব শরীরের মারাত্মক ও মরণঘাতি রোগগুলোর মধ্যে স্তন ক্যান্সার অন্যতম। ক্রমেই বাড়ছে এই রোগের পরিধি। তবে স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে আগে থেকেই জানা থাকলে এর চিকিৎসা সহজ হয়। স্তন ক্যান্সারের লক্ষণগুলো জানা থাকলে আগেভাগেই চিকিৎসা নিয়ে এই রোগকে প্রতিরোধ করা অনেকটাই সম্ভব। এসব বিষয় নিয়ে ডক্টর টিভির সঙ্গে কথা বলে বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডা. সানজিদা হোসেন পাপিয়া
ডক্টর টিভিঃ স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে কিছু বলুন?
ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদারঃ স্তন ক্যান্সারকে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে বলতে হয়, এটা শরীরের অন্যান্য ক্যান্সারের মতোই। তবে স্তন ক্যান্সার শুধু ম্যামালি গ্ল্যান্ড বা স্তনে হয়ে থাকে। এখানে যে সেল বা কোষগুলো থাকে সেগুলো অস্বাভাবিক বিভাজনের মাধ্যমে ক্যান্সারে পরিণত হয়।
ডক্টর টিভিঃ কি কি কারণে স্তন ক্যান্সার হয়?
ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদারঃ স্তন ক্যান্সারের পেছনে অনেক কারণ থাকে। একটা হচ্ছে জিনগত বা পারিবারিক। যেমন, কোনো পরিবারে মা, খালাদের মধ্যে কারো স্তন ক্যান্সার থাকলে, সেই পরিবারে মেয়েদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার অনেক বেশি ঝুঁকি থাকে। আরেকটা বিশেষ কারণ হচ্ছে ওবেসিডি বা অতিরিক্ত ওজন। যাদের ওজন অনেক বেশি, বা ঠিকমতো খাদ্যাভ্যাস মেনে চলেন না, ফাস্টফুড বা চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রেও এটার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। আবার যাদের আর্লি মিনার্কি হয় অর্থাৎ মাসিক বা পিরিয়ডটা অনেক আগে শুরু হয়, কিন্তু লেট মেনোপজ বা মাসিকটা অনেক দেরিতে শেষ হচ্ছে, তারাও এই স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছেন।
কর্মজীবী মায়েরা আগের মতো বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় পান না, এটাও কিন্তু স্তন ক্যান্সারের একটা মূল কারণ। আরেকটা কারণ হচ্ছে, খাবারে ভেজাল বা ফরমালিনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। যার ফলে যেকোনো ধরণের ক্যান্সার হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খাওয়াটাও স্তন ক্যান্সারের একটা কারণ।
ডক্টর টিভিঃ প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি?
ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদারঃ অনেকেই মনে করেন স্তনে একটা চাকা থাকা মানে সেটা স্তন ক্যান্সার। এটা একটা ভুল ধারণা। স্তনে চাকা থাকা মানেই স্তন ক্যান্সার আর চাকা না থাকা মানে যে ক্যান্সার না এরকমও না। কারণ, স্তনে চাকা না থাকলেই আমাদের স্ক্রিনিং এর প্রয়োজন হয়। স্তনে চাকা না থাকলেও স্তন ক্যান্সার হতে পারে, যদি পরিবারগত রোগটি হয়ে থাকে। আবার জিন যদি পজিটিভ থাকে যেমন, বিআরপি-১, বিআরপি-২, পিপিপি-৩ জিন, এই জেনেটিক প্রিডিস্পজিং যে ফ্যাক্টর সেগুলোর কারণেও স্তন ক্যান্সার হতে পারে।
ডক্টর টিভিঃ লক্ষণগুলো দিয়েই কী স্তন ক্যান্সারের পর্যায় বিবেচনা করা যথেষ্ট?
ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদারঃ যেসব রোগীর স্ক্রিনিং করে ফ্যামিলি হিস্ট্রি পজিটিভ পাওয়া যায়, তাদের ৩০ বছর বয়সের আগেই স্ক্রিনিং এর আওতায় আসতে হয়। স্ক্রিনিং এর একটা প্রটোকল আছে, সেই প্রটোকলের আওতায় আসতে হবে। সেটা সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো হাসপাতালেই করা যাবে। সেক্ষেত্রে সে হয়তো ৪০ বছর বয়সে আমাদের কাছে আসলো, আমি তাকে স্ক্রিনিং করার সুবাদ একটা মেমোগ্রাফি করতে দিলাম। এই মেমোগ্রাফিটা অনেকটা এক্স-রের মতো একটা পরীক্ষা। সেই মেমোগ্রাফিতে যদি একটা সাবুদানা বা একটা ডট লাইক লেশনও দেখা যায়, তাহলে তারও কিন্তু স্তন ক্যান্সার হয়ে গেছে। কিন্তু সে হয়তো হাত দিয়ে চাকা অনুভব করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে পরবর্তী ডায়াগনসিসগুলো করতে হবে।
ডক্টর টিভি: কি কি লক্ষণ নিয়ে স্তন ক্যান্সারের রোগীরা আসেন?
ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার: চাকা না থাকলেও অনেকের স্তন ক্যান্সার হচ্ছে। আর যাদের চাকা আছে তাদের তো আমরা টেস্ট করতে দেই। আবার, অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় নিপল বা অ্যারিওলার চারদিকে সেটা ডিসফিগারেশন হয়ে যেতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে ব্রেস্টের স্কিন কমলালেবুর খোসার মতো হয়ে যেতে পারে এবং নিপলটা ভিতরে ঢুকে যেতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিপল থেকে রস জাতীয় পদার্থ বের হয়।
এডভান্স স্টেজ বা প্রাথমিক ধরণে অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বগল থেকে অনেকগুলো লিম্ফনোট অ্যাক্সিলাতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরের এডভান্স লেভেলে যারা আসেন তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, জন্ডিস নিয়ে রোগী আসেন অর্থাৎ লিভারকে ইনভল্ভ করে ফেলেছে। অনেকসময় ব্রেইনকেও ইনভলভ করে ফেলে, সেক্ষেত্রে রোগী চোখে কম দেখে। অনেকসময় যদি ফুসফুসকে ধরে ফেলে দেখা যায় কাশির সাথে রক্ত বের হচ্ছে। তারপরে যদি হাড়কে ধরে ফেলে দেখা যায় পা ব্যাথা করছে, হাত ব্যাথা করছে। এধরণের অনেক সিম্পটোম নিয়েই রোগীরা আমাদের কাছে আসে। আর সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো এই করোনা পেন্ডেমিকে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করার পরে এই এডভান্স সিম্পটোমগুলো নিয়েই রোগীরা আমাদের কাছে আসছে।
ডক্টর টিভি: কোন বয়সে রোগীদের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি?
ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার: স্তন ক্যান্সার বা ওভারিয়ান ক্যান্সারের ফ্যামিলিয়াল হিস্ট্রি আছে। এরকম নারীদের মধ্যে আমরা ২৪ বছর বয়সের স্তন ক্যান্সারের রোগীও পাচ্ছি। আবার, যাদের ফ্যামিলি হিস্ট্রি নেই কিন্তু ব্রাকা-১, ব্রাকা-২ এসব জীন পজিটিভ সেসব নারীদের ক্ষেত্রে সাধারণত ৩৪-৩৫ বছরে তারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে বেশীরভাগ রোগী থাকে ৪০ বছরের উর্ধ্বে এবং ৫০ বছরের উপরে সবচেয়ে বেশি স্তন ক্যান্সারের রোগী পাওয়া যায়।