খাবার গিলতে না পারার কি যে কষ্ট?
খাবার গিলতে না পারার কষ্ট (ইনসেটে ডা. মুহিব্বুর রহমান রাফে)
স্ট্রোক কিংবা অন্য যে কারণেই হোক, নিশ্চয়ই নাকে খাবারের নল পড়া রোগীদের দেখে থাকবেন? আবার খেতে গিয়ে শ্বাসনালীতে চলে যাচ্ছে এমন ভয়ানক দৃশ্যে আমরা অনেকেই দেখেছি।
ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগে স্ট্রোক বা প্যারালাইসিস রোগীকে আবার সচল করা এবং তার অন্যান্য সমস্যা সমাধানের জন্যও কাজ করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গিলতে না পারা সমস্যা নিয়ে কাজ করা। একে বলে Swallowing Rehabilitation. এই টিমে একসাথে কাজ করেন ফিজিও, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্টসহ আরো অনেকে। মূলতঃ অকুপেশনাল থেরাপিস্ট; কিভাবে খাদ্য গ্রহণকে সহজ করা যায় সেটির সমাধান নিয়ে কজ করেন।
আসেন, গ্রহণের জন্য খাবার যখন মুখে নেই, তখন কি ঘটে, সেটি নিয়ে একটু জানি। চারটি স্টেশনে কাজ হয়।
প্রথম স্টেশন মুখ গহ্বরের শুরুতে, এখানে দাঁতে চিবিয়ে টুকরো করার কাজ চলে, নেড়ে চেড়ে দেয় জিহ্বা এবং লালা রসের সাথে মিশিয়ে সেটি পরের স্টেশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ধরুন, ঝামেলাটি জিহ্বায় কিংবা চোয়ালের মাংসপেশীতে, রোগী চিবুতেই পারছেনা, তাহলে আধা শক্ত খাবার গিলবে কিভাবে? না পারলেই তখন লালা ঝরে, খাবার গালে পোটলা বেঁধে থাকে। সুতরাং তাকে সমাধান দিতে হবে কিন্তু এখানে। গলায় নয়।
এবার, স্টেশন দুই। টুকরো করা ভেজা খাবার পাঠানো হলো মুখ গহ্বরের পেছনের অংশে। এখানে খাবার থাকার কথা মাত্র এক সেকেন্ড। গলার নরম অংশে প্যারালাইসিস বা সমস্যা হলে সেটি আর হবেনা। সুতরাং দেখা যাবে, এখানেও লালা ঝরে, খাবার গালে পোটলা বেঁধে আছে বা রোগী মাথা নিচু করে মুখে খাবার নিয়ে বসে আছে। তাহলে; সমাধান করতে হবে এ অংশে। ধরুন, এ দুটো স্টেশনই ভালো আছে। সমস্যা?
এবার তৃতীয় স্টেশনে, যার নাম গলবিল বা Pharynx। জায়গাটি আলজিহ্বার পরেই। এখানে খাবার আসা মাত্র ১ সেকেন্ডের কম সময়ে সেটি খাদ্যনালীতে দৌড়ে যাবেই। এটাই নিয়ম।কিন্তু দেখা গেল, না গিয়ে খাবার আটকে আছে, শ্বাসনালীতে খাবার চলে যাচ্ছে, গড়গড় করে কথা বলছে, নাক দিয়ে খাবার চলে আসছে। এসমস্যায় বারবার মুখে খাবার দেয়া মানে তার জন্য বিপদ ডেকে আনা। এর অর্থ হচ্ছে নির্ঘাত ফুসফুসে ইনফেকশন হবে। হঠাৎ করে এ ধরনের রোগী আধা সচেতন, ডাকলে সাড়া দিচ্ছেনা, গিলতে পারছেন না, শ্বাস নিতে কষ্ট । বুঝতে হবে, ঝামেলা পাকাচ্ছে। খাবার পেটে নয়, যাচ্ছে অন্য কোথাও।
এবার আসেন, সর্বশেষ স্টেশনে। খাদ্যনালী। এখানে খাবার আসলেই চ্যালচ্যালায়া পাকস্খলীতে দৌড়ে যাবার কথা। সমস্যা যদি এখানে হয়, তাহলে রোগী কিন্তু খাবার আটকানো- কাশি-দম আটকে যাওয়া বা শ্বাসনালীতে খাবার যাওয়া-গড়গড় করে কথা বলা, নাক দিয়ে খাবার চলে আসা সাধারনত হয়না। উল্টো বলবে, ঢোক গেলা যায় তবে বুকে কি যেন আটকে আছে, বুক জ্বলে, বুক ভারী। সুতরাং সমাধান করার আগে এন্ডোসকপি করে স্টেশন চারের খবর নিতে হবে।
গিলতে না পারার সবচাইতে বেস্ট পরীক্ষা হলো, ভিডিওফ্লুরোস্কপি। সোজা বাংলায় খাবার মুখে দিয়ে চাবানোর এক্সরে ভিডিও দিয়ে রেকর্ড করে দেখা।
চলেন দুটো ভিডিও দেখে আসি। কোরিয়ান রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ দেখালেন প্রথম রোগীটার শেষ থেকে পেটে যাবার আগ পর্যন্ত কোন সমস্যা না হলেও পরের রোগীটার সুস্পষ্ট ভাবে ফুসফুসে খাবার চলে যাচ্ছে।
চার স্টেশনের সমস্যায় চার ধরনের সমাধান। এজন্য দরকার হবে ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞের সিদ্ধান্ত। প্রটোকল অনুযায়ী সমস্যা নির্ণয় করে তখন নাকে নল নাকি রিহ্যাবিলিটেশন ঠিক করতে হবে; যেমন থুতনি বুকে লাগিয়ে রাখা, মাথা ঘুরিয়ে রাখা, নাক বন্ধ করে অতপর গেলা, কান দিয়ে শ্বাস বের করার চেষ্টা করে গেলা, আরো কত কি?? মজার ব্যাপার কি জানেন, গিলতে না পারা রোগীর জন্য সবচাইতে বেস্ট ট্রিটমেন্ট হলো বারবার একটু একটু করে গেলানোর প্রচেষ্টা করা।
ডা. মুহিব্বুর রহমান রাফে
ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ