সকল হলুদ জন্ডিস নয়
শিশুর হাত হলুদ বরণ হয়ে যাওয়া
"সকল হলুদ জন্ডিস নয়
কিছু হলুদ ক্যারোটেনেমিয়া তেও হয়"
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স শিশু বহির্বিভাগ:
১৭ মাসের রৌদ্র (ছদ্মনাম) কে নিয়ে, তার মা এসেছে। মা’র চোখে মুখে চিন্তার ছাপ।
"কি হয়েছে" জানতে চাওয়াতে বললো: রৌদ্রের শরীর হলুদ হয়ে যাচ্ছে,বেশ অনেক দিন ধরে জন্ডিস ওর, কিছুতেই কমছে না। বহু চিকিৎসা করেছি, কিন্তু জন্ডিস কমার কোন লক্ষণ নেই, মুরুব্বিরা বলছে ওর লিভার বড় হয়ে গেসে।
আমি রৌদ্রের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পাশাপাশি জিজ্ঞেস করতে লাগলাম: কি কি চিকিৎসা করেছেন?
মা: হাত পা ঝাড়াইসি, হাত পা ধোয়াইয়া জন্ডিস নামাইসি, পানি পড়া খাওয়াইসি, কিন্তু কিছুতেই জন্ডিস কমছে না।
আমি: রৌদ্রকে কি খাওয়ান?
মা: খিচুড়ি, ভাত, দুধ।
আমি: খিচুড়ি বা ভাতের সাথে কি দেন, মানে শাকসবজি?
মা: মিষ্টি কুমড়া, গাজর, ডাল, ডিম, মাছ
আমি: গাজর, মিষ্টি কুমড়া প্রতিদিন দেন?
মা: গাজরটা বেশি খায় ও, সাথে মিষ্টি কুমড়া।
রৌদ্রর খাদ্যাভ্যাস জেনে, সেই সাথে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত হলাম এটা জন্ডিস নয়। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য রক্তের বিলিরুবিন পরীক্ষা করতে দিলাম এবং মাকে বুঝিয়ে বললাম, রৌদ্রের যে রোগটি হয়েছে- সেটি জন্ডিস নয়। তার নাম Catotenemia (ক্যারোটেনেমিয়া)।
"সকল হলুদ জন্ডিস নয়, কিছু হলুদ ক্যারোটেনেমিয়া-তেও হয়"
গাজর, মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু-সহ যেকোনো হলুদ, কমলা বা লাল রঙের শাকসবজি-ফলমূল হলো ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার, দীর্ঘদিন ধরে অধিক পরিমাণে এসব ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে রক্তে beta carotene লেভেল বেড়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে চামড়ার নীচে ক্যারোটিন জমা হয়ে চামড়ার রং হলুদ বা কখনও কখনও কমলা আকার ধারণ করে।
ক্যারোটিনের এই আধিক্যের জন্য চামড়ার রঙ হলুদ হয়ে যাওয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে carotenemia। শরীরের যেসব জায়গায় চামড়া মোটা অর্থাৎ হাতের তালু, পায়ের তালুতে সাধারণত ক্যারোটিন জমা হয়ে থাকে। তাই হাতের তালু আর পায়ের তালু হলুদ দেখা যায়।
ক্যারোটিন হলো আমাদের শরীরের ভিটামিন-এ'র প্রধান উৎস। ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পর তা শরীরে গিয়ে ভিটামিন-এ তে রূপান্তরিত হয়। তবে আমাদের শরীর প্রতিদিন খুবই সীমিত পরিমাণে ক্যারোটিন থেকে ভিটামিন-এ তৈরি করে থাকে। কাজেই অধিক পরিমাণে ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেলেও তা থেকে সীমিত পরিমাণেই ভিটামিন-এ উৎপন্ন হয়ে থাকে এবং বাড়তি ক্যারোটিন রক্তে জমা হতে হতে একসময় চামড়ার নীচে এসে জমা হয়। চামড়ার এই হলুদাভ বর্ণ ধারণ করার জন্য প্রায়শই অনেকে ক্যারোটেনেমিয়াকে জন্ডিসের সাথে গুলিয়ে ফেলে।
জন্ডিসের সাথে ক্যারোটেনেমিয়ার প্রধান পার্থক্য হলো, জন্ডিসে চোখের sclera হলুদ হয়ে থাকে এবং লিভার বড় হতে পারে। ক্যারোটেনেমিয়াতে চোখ স্বাভাবিক থাকে, লিভার বড় হয় না। জন্ডিসে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায়,
ক্যারোটেনেমিয়াতে বিলিরুবিন বাড়ে না। জন্ডিস আমাদের জন্য ক্ষতিকারক এবং এর জন্য প্রকারভেদে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। ক্যারোটেনেমিয়া ক্ষতিকারক নয় এবং এতে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিলে, কয়েক মাসের মধ্যে আস্তে আস্তে হলুদ রঙ কমে শরীরের রঙ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তাই বলে কি ভয়ে আমরা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ হলুদ, কমলা বা লাল রঙের শাকসবজি ফলমূল বাচ্চাদের খাওয়াবো না?
উত্তর: অবশ্যই খাওয়াবো
ভিটামিন-এ আমাদের চোখের জন্য, ত্বকের জন্য, বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের অতি প্রয়োজনীয়। ভিটামিন-এ'র অভাবে চোখে রাতকাণা রোগ হয়, ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়, ভিটামিন-এ মিজেলস, ডায়রিয়া প্রতিরোধ করে থাকে। কাজেই ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার অবশ্যই প্রতিদিন খাওয়াব, কিন্তু পরিমিত পরিমাণে খাওয়াব।
কৃতজ্ঞতাঃ
ডা. ইসমাত আলো, (এমডি শিশুরোগ)
মেডিকেল অফিসার, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।