বাতব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা
শরীরের বিভিন্নস্থানে বাতব্যথা (ইনসেটে লেখক)
যত ধরনের বাতব্যাথা আছে, এগুলোর মধ্যে বয়স ও লিঙ্গ নির্বিশেষে যে রোগটি বেশি দেখা যায় তার নাম গেটেবাত বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। এটিকে শিশুদের গলার ইনফেকশন পরবর্তী যে রিউমাটিক জ্বর হয় তার সাথে অনেকে গুলিয়ে ফেলেন কিন্তু দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের রোগ।
সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে প্রথাগত ধারণা রয়েছে যে, শুধুমাত্র গিটে গিটে ব্যথাই বোধকরি বাতব্যথার একমাত্র লক্ষণ এবং আরেকটি বদ্ধমূল ধারণা এই বাতরোগ এটি শুধুমাত্র প্রবীণ বা বয়স্কদের ই হয়ে থাকে, অন্যকারো নয়। এই লেখায় কিশোর থেকে প্রৌঢ় সকল বয়সে গেটেবাতের(রিউমাটয়েড আর্থাইটিস) কারণ বিশ্লেষণ, ব্যথাসহ আরো যে বিচিত্র ধরণের লক্ষণাদি হয়ে থাকে সেগুলো উল্লেখ পূর্বক এসব জটিল রোগের আধুনিক চিকিৎসা ও সেগুলোর প্রাপ্যতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করব।
প্রথমে এটা জানা প্রয়োজন যে বাতবিজ্ঞান (রিউমাটোলজির) ভিত্তি কি?
এককথায় বললে, এটি কঠিন শোনাবে তাই একটি সাধারণ বিষয় আগে বলে নেই, মানব শরীরে বহিরাগত কোন রোগজীবাণু যেমন, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে, শরীরের প্রহরীকোষ বা বিপদ সংকেতব্যবস্হা সেটি টের পায় এবং এসবের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে রক্তে “এন্টিবডি” নামে এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করে যা এসব জীবাণু কোষ বা ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে আমাদের এসব ইনফেকশন বা সংক্রামক ব্যধি থেকে রক্ষা করে। এখন জীবাণু প্রতিরোধী এসব উপকারী এন্টিবডি শুধুমাত্র শরীরে প্রবেশকৃত শত্রুর বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল থাকার কথা। কিন্তু জিনগত ত্রুটির কারণে বা শরীরে কোন দীর্ঘমেয়দি দূষক বা জীবাণু প্রবেশের ফলে উপকারী ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই ধরনের এন্টিবডিগুলো শরীরের সুস্হকোষ যেমন, অস্হিসন্ধি, মেরুদন্ড, রক্তনালী, স্নায়ু, লালাগ্রস্হি, ফুসফুস, কিডনি, ত্বক এমনকি মস্তিষ্ক ও চোখ আক্রমণ করে এবং প্রদাহ তৈরি করে। এই প্রদাহের ফলেই মূলত গিটে ব্যথাসহ অন্যান্য লক্ষণ তৈরি হয়। এর ফলেই অস্থিসন্ধির নড়নক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সেখানে আনুষঙ্গিক গাঠনিক উপাদান হিসেবে যে লিগামেন্টগুলো থাকে সেগুলোতেও প্রদাহ ছড়িয়ে পড়ে। এরুপ ঘটনাকে বলে অটোইমিউন রোগ বা শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজের বিরুদ্ধে নিজেই কাজ করে ধ্বংসলীলা ঘটাচ্ছে এবং অঙ্গসমূহে অতিরিক্ত প্রদাহ সৃষ্টি করার মাধ্যমে ব্যথাসৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থের ক্ষরণ বাড়িয়ে দিয়ে শারীরিক কষ্ট বা লক্ষণ সৃষ্টি করে।
অটোইমিউন কারণে সৃষ্ট গেঁটেবাত রোগের নাম, বয়স ও লক্ষণ জেনে নেই-
* গেঁটেবাত বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসঃ
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর হাত-পা এর আঙ্গুল, কব্জি বা গোড়ালী সন্ধিগুলোর ব্যথা থাকে জোড়ায় জোড়ায়, ধীরে ধীরে হাত-পা নড়াচড়া করে সচল করলে ঘন্টাখানেক পর ব্যথা হ্রাস পায়। এছাড়াও হাত-পা এ ঝি-ঝি অনুভূতি হতে পারে, চোখে প্রদাহ বা লাল হতে পারে, এমনকি করোনারী প্রদাহের ফলে হৃদরোগ পর্যন্ত হতে পারে।
এই রিউমাটয়েড বাত কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী থেকে মধ্যবয়স বা বৃদ্ধবয়স যেকোন বয়সে হতে পারে। আবার কৈশোরে এইবাত হলে একে বলে জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস। রোগ নির্ণয় এর জন্য রক্তপরীক্ষায় বিশেষ এন্টিবডির উপস্থিতি দেখা হয় যেমন, RA Test, Anti CCP Antibody এবং সংশ্লিষ্ট হাত বা পা এর এক্স-রে করে বিশেষ ধরনের ক্ষয় আছে কিনা তা যাচাই করে তবেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে আসলে গেটেবাত নাকি অন্য ধরনের বাতব্যথা যেমন, চর্মরোগ জনিত ব্যথা(সোরিয়াটিক বাতব্যথায় অনুরূপ লক্ষণ হয়ে থাকে তবে ব্যথার তীব্রতা ও এক্স-রে তে ক্ষয়ের অবস্থান আঙ্গুলের শেষ গিটে বা Distal Interphalangeal Joint এ পাওয়া যায়)।
গেঁটেবাতের আধুনিক চিকিৎসাঃ
বাতরোগের চিকিৎসা প্রথাগতভাবে স্টেরয়েড ধরনের ব্যথানাশক প্রয়োগ আর মুখে খাওয়ার সাধারণ প্রদাহবিনাশী বড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। আধুনিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতি প্রয়োগ করে যেমন রক্তপরীক্ষা ও ডিএনএ পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে এসব রোগ এখন আর অজানা থাকছে না, সম্পূর্ণ ডায়াগনসিস করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি এখন আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্হার মাধ্যমে রোগলক্ষণ প্রশমিত করা সম্ভব। এছাড়াও সহযোগী চিকিৎসা ব্যবস্হা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ফিজিওথেরাপি (হস্তগত ব্যায়াম ও বিভিন্ন প্রযুক্তিগত মেশিনের মাধ্যমে আক্রান্ত অস্হিসন্ধিকে নমনীয় করা হয়) প্রয়োগ করে বাত উপশম করা যায়। পাশাপাশি বাত প্রতিরোধে খাদ্যাভাসের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে যেমন,
১. হলুদ বা কিউকারমিন
২. আদা
৩. গ্রীণ টি বা ক্যাটেকিন
৪. আনারস
৫. চেরিফল বা এর রস
৬. টক ফল মাল্টা, কমলা, লেবু
৭. যেকোন বেরি যেমন, স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, মালবেরি
৮. গাজর
৯. অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল
১০. মোটা শস্য বা হোল গ্রেইন বা ওটস।
এগুলো বাত বা প্রদাহ প্রতিরোধী খাবার হিসেবে গবেষণায় প্রমাণিত।
আধুনিক চিকিৎসা বলতে যা বোঝানো হচ্ছে-
ক। বায়োলজিক চিকিৎসা- সাধারণ বাংলায় বললে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। এর অর্থ যেসব এন্টিবডি রক্তে বেশি মাত্রায় থাকার বলে অটোইমিউন বাতরোগ হচ্ছে সেসব এন্টিবডির বিরুদ্ধে মনোক্লোনাল এন্টিবডি প্রয়োগ করে রক্তে থাকা ক্ষতিকর বাতসৃষ্টিকারী এন্টিবডি ধ্বংস করা হচ্ছে। এগুলো বিশেষ ধরনের ব্যথামুক্ত ইনজেকশন রা ত্বকের নিচে বা শিরাপথে দিলে রোগ উপশম হচ্ছে।
খ। পিআরপি- আঘাতজনিত বা বয়সজনিত অস্টিওআর্থ্রাইটিস এবং ডায়াবেটিস জনিত কাঁধের ব্যথায় যুগান্তকারী চিকিৎসা পিআরপি। রোগির রক্ত থেকে ছাঁকনকৃত রক্তের হলুদ অংশের মধ্যে যে অনুচক্রিকা থাকে সেটিকে পৃথক করে, এই হলুদ তরলটি আক্রান্ত অস্হিসন্ধির মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। রক্তের অনুচক্রিকার মধ্যে থাকা পুষ্টি উপাদান বা গ্রোথফ্যাক্টর ক্ষয় হয়ে যাওয়া অস্সিসন্ধির পুনর্জাগরণের খাদ্য হিসেবে কাজ করে ব্যথা নিরাময় করে।
গ। স্টেমসেল থেরাপি- ক্ষয়িষ্ণু অস্হিসন্ধিকে আবার পুনর্জাগরণী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সচল করা সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সকল গবেষণা স্টেমসেলকে ঘিরে। রোগীর অস্হিমজ্জা বা চর্বির মধ্যে জমে থাকা স্টেমকোষ বা মাতৃ কোষগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছাঁকন করে সেই বিশুদ্ধ স্টেমসেল তরল আকান্ত অস্হিসন্ধি বা অঙ্গে প্রতিস্হাপন করলে সেই অঙ্গে নতুনভাবে কোষবিভাজনের ফলে আক্রান্ত অস্হিসন্ধি পুনরায় নড়নক্ষমতা ফিরে পাচ্ছে।
ঘ। প্রো-বায়োটিক থেরাপি: বলা হয়ে থাকে, সচল অটোইমিউন বাতের উৎস পরিপাক নালীতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য আর উপকারী ব্যাকটেরিয়া হ্রাস পাওয়া। তাই, উপকারী ব্যাকটেরিয়া খাদ্যে গ্রহণের মাধ্যমে রক্তে এন্টিবডি তৈরির প্রবণতা কমানো যায়।
এইসমস্ত আধুনিক চিকিৎসাগুলোর কোনটি কোন ধরনের রোগীর জন্য প্রযোজ্য তা রোগীর রোগের অবস্থা, জটিলতা ও অর্থনৈতিক অবস্হার সাথে সঙ্গতি রেখে নির্ধারণ করবেন একজন ইন্টারভেনশনাল রিউমাটোলজিস্ট। তাই, বিচলিত না হয়ে বাতরোগের যেকোন লক্ষণ অনুভব করলেই পরামর্শ নিন একজন রেজিস্টার্ড বাতব্যথা বিশেষজ্ঞের।
লিখেছেন
ডা. মন্জুর এ খোদা
এমবিবিএস(আর ইউ), এমআরসিপি(লন্ডন, ইউ্কে)
ইউলার ইসিআরডি ইন রিউমাটোলজি, সুইজারল্যান্ড।
ইর্ন্টানাল মেডিসিন ও রিউমাটোলজি(বাত) বিশেষজ্ঞ।
ইন্টারভেনশনাল রিউমাটোলজিস্ট, ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিকস, মালিবাগ ঢাকা
হেড অব রিউমাটোলজি, বেটারলাইফ হাসপাতাল, রামপুরা, ঢাকা।