রোজাঃ শরীর ও মনের রসায়ন
‘রোজা : শরীর ও মনের রসায়ন’ বিষয়ে লিখেছেন ডা. শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা
এসে গেছে পবিত্র মাহে রমজান। শুরু হয়ে গেছে সেহরি ইফতারের ক্ষণ গণনা। রোজার আগে পরে খাবারের মেন্যু ঠিক করা। সেহরিতে ওঠার জন্য এলার্ম সেট করা।
ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আমরা তো রমজানে প্রবেশ করেছি, কিন্তু রমজান আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে কি?
রোজা বলতে প্রাথমিকভাবে আমরা বুঝি না খেয়ে থাকা।
অর্থাৎ রোজার প্রথম প্রভাব ক্ষুধা। বিশেষ করে প্রাত্যহিক খাবারের সময় গুলোতে এই ক্ষুধার স্মরণ আমাদের বিচলিত করে তোলে।
প্রথম ৪ ঘন্টা রোজা শুরুর এই সময়টাতে আমরা তেমন কিছু বুঝতে পারিনা। কারণ এসময় রক্তে যতটুকু গ্লুকোজ থাকে তা অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন ব্যবহার করে শরীরে প্রয়োজন শক্তি সরবরাহ করে। ইনসুলিনের এই কর্মকাণ্ড টাইপ টু ডায়াবেটিস (ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স) রোগীদের জন্য বড় উপকারী।
৪র্থ ঘন্টার পর থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগাতে শরীর খুঁজে বেড়ায় তার সঞ্চিত ভান্ডার। ১২ ঘন্টার দিকে সাড়া পরে যায় শরীরের খুবই যত্ন করে রাখা, জমানো শক্তি ভান্ডারে, যাকে বলা হয় চর্বি বা ফ্যাট। এই পর্যায়টি রমজানের রোজা রেখে ওজন কমানোর পর্যায়।
অনেকেই বলেন, 'রোজা রাখলাম, কিন্তু আমার ওজন তো কিছুই কমলো না? পক্ষান্তরে যদি ওজন বাড়ে তাহলে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। কেননা যতটুকু বাড়ছে পুরোটাই চর্বির ওজন। এ সময় পেশির ওজন খুব কম বাড়ে।
মূলত রোজা শুরুর আগে কি খাবার খাওয়া হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে চর্বি পোড়ানোর পর্যায় কখন আসবে। প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট/শর্করা (ভাত আলু খিচুড়ি বিরানি) খাবার খেলে এ পর্যায় দেরিতে শুরু হয়। অন্যদিকে চর্বি বা প্রোটিন জাতীয় খাবার খেলে এই পর্যায়টি তুলনামূলক দ্রুত আসে। অর্থাৎ আপনার খাবার মেন্যুর ওপর নির্ভর করবে রোজায় আপনার শরীর আপনাকে কতটুকু ওজন কমিয়ে দেবে। শুধু না খেয়ে থাকাই সব নয়।
এই ধাপের শেষে সাধারণত চর্বি ভেঙে এসিড উৎপন্ন হয়। সেখান থেকে তাপ। সেটা ত্বরান্বিত করে শরীরের বিপাক ক্রিয়া এতে হজম শক্তি বেড়ে যায়। কিন্তু অনেকেই এসিডিটির কমপ্লেন করেন। এর সাথেও সেহরি খেয়ে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়া, অতিরিক্ত মসলাদার খাবার জড়িত।
১৬ ঘন্টা দিকে শুরু হয় অটোফেজি প্রক্রিয়া। রোজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যে সময়টি আমরা বলি 'রোজা লেগে গেছে'।
অটোফেজি প্রক্রিয়ায় শরীর তার বিপাকক্রিয়ায় ফলে উৎপন্ন সেইসব ক্ষতিকর এবং মৃত বর্জ্যকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়, যেগুলো আমাদের স্মৃতিক্ষয়, বার্ধক্য, ক্যান্সার, পাথর অনেক দীর্ঘ মেয়াদী রোগের কারণ। আর এই সমস্ত সুস্থতার প্রক্রিয়াগুলো আসলে দীর্ঘ সময় পাকস্থলী খালি থাকাতেই ঘটছে, বলছে মাইন্ডবডিগ্রিন ডটকম ওয়েবসাইট।
পুরো একমাস রোজা রাখায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো দৈনিক ৫-৬ ঘন্টা বিশ্রামের সুযোগ পায়। দেহের পুরনো ক্ষতিগ্রস্ত শ্বেত রক্তকণিকা রিসাইক্লিং পদ্ধতিতে আবার জেগে ওঠে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আগের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
শারীরিক এত এত উপকারের সাথে সাথে মানসিক অবসাদ দূর করে মনকে সচল রাখাও রোজার অন্যতম গুণাবলী। দেখবেন রোজার শেষের দিকে অন্য কারণে আপনার ভীষণ রাগ হলেও আপনি রাগ করতে পারছেন না। একে তো শরীরের জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে, অন্যদিকে মানসিকভাবে আপনি রাগ না করে শক্তি রিজার্ভ করে রাখার কথা ভাবছেন। 'আজ রোজা, আজ মিথ্যা বলা যাবে না' ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে আপনিও হয়তো এই বুলি আওড়েছেন।
যে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য এই পৃথিবীতে আসা সেই খাবারের লোভকে নিয়ন্ত্রণ করে, শরীর ও মনকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার মাধ্যমে রোজা আমাদেরকে প্রকৃতির বিস্ময়কর হিলিং পাওয়ার এর সাথে আমাদের মেলবন্ধন করিয়ে দেয়। চন্দ্রমাসের আবর্তনের সাথে সাথে রমজানের এই আবর্তন প্রকৃতির সাথে আমাদের এই মেলবন্ধনকে আরো গাঢ় করতে। তাই কোন রমজানে আমরা লেপ থেকে উঠতে কষ্ট হয়, কোন রমজানে গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা।
দিন শেষে আমরা যতই সবুজ, যতই প্রাকৃতিক, ততই ক্ষমতাবান...
স্রষ্টা এই তত্ত্ব জানান দেন।
যেহেতু খাবারদাবারের উর্ধ্বে গিয়ে এক বিরাট মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে রমজান আমাদের জীবনে আসে তাই কোনভাবেই অতিরিক্ত খাবার খেয়ে, মসলাদার খাবার খেয়ে, পানি, ফল, শরবত কম খেয়ে আপনার সুস্থতার দরজা বন্ধ করবেন না। যতটা সবুজ খাবারের সাথে থাকবেন ততই মঙ্গল। আঁশ জাতীয় খাবার আপনাকে কোষ্ঠকাঠিন্য মুক্তি দেবে। দুধ টক দই খেজুর পুরোটা দিন এনার্জি দেবে। গভীর রাতে উঠতে পারেন না দেখে সারারাত জেগে সেহেরি করে ঘুমাবেন না। তারাবির নামাজে মাত্র ২০০ ক্যালরি শক্তি খরচ হয়। খাবারের পর এই একটু ব্যায়াম কি যে উপকারী!
খাবার নিয়ন্ত্রণ, হালকা ব্যায়াম, মানসিক সংযম মাত্র একমাসেই সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষ হয়ে ওঠার সুযোগ আপনার সামনে...
প্রতিদিন ছোট্ট করে একটা ভালো কাজ হোক।
হোক সেটা আপনার রিক্সাওয়ালাকে নিয়ে ইফতার করা, ইফতার পার্টিতে দাওয়াত খেতে গিয়ে খাবার নষ্ট না করা, আপনার কাছের বন্ধু, যে কখনো মুখ ফুটে তার পরিবারের সমস্যার কথা বলে না তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা, কি হয়েছে জানতে চাওয়া..
করা তো পরের কথা
শুধু ভাবুন আগে..
মন থেকে কেমন একটা সুখ সুখ লাগছেনা!!
হয়তো আমাদের এই সুখ দিতেই রমজান আসে..
আমাদের শুধু সুখগুলো কুড়োনোর পালা..
রমজান আমাদের জীবনে প্রবেশ করুক ..গভীর থেকে গভীরতর হৃদয় উপলব্ধি হয়ে।
খোশ আমদেদ মাহে রমজান।
লেখক :
ডা. শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা
এম.ও.সি.এস
সিভিল সার্জন কার্যালয় খুলনা।