কিছু অভ্যাস বদলে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব ভয়াবহ পিসিওএস
পিসিওএস সচেতনতা মাস উপলক্ষে রেনেটা আয়োজিত ওয়েবিনার
ভয়াবহ এক রোগ পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস)। এতে আক্রান্তরা অল্প দিনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তবে জীবনাচরণ বদলে পিসিওএস রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
পিসিওএস সচেতনতা মাস সেপ্টেম্বর উপলক্ষে সম্প্রতি প্রথম আলো ও রেনেটা আয়োজিত ওয়েবিনারে এসব মতামত উঠে আসে। ওয়েবিনারের আয়োজক পিসিওবি, বাংলাদেশ।
ওয়েবিনারে বক্তারা বলেন, হরমোনজনিত পিসিওএস রোগে আক্রান্তদের নানা সমস্যা দেখা দেয়। জীবনের স্বাভাবিক আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত হন। এ রোগে আক্রান্ত নারীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তানধারণে দেরি হয়। এমনকি অনেকে বন্ধ্যাত্বের শিকার হন। কিছু ক্ষেত্রে রোগটি জেনেটিক হলেও কিশোরীদের আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী স্থূলতা, জাঙ্কফুটে আসক্তি ও ঠিকমতো শরীর চর্চা না করা।
ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন পিসিওবি বাংলাদেশের সভাপতি মেজর (অব.) অধ্যাপক ডা. লায়লা আরজুমান্দ বানু। প্রধান অতিথি ছিলেন পিসিওবি বাংলাদেশের জাতীয় উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. টি এ চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন- পিসিওবি’র জাতীয় উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম। সঞ্চালনা করেন পিসিওবি’র মহাসচিব অধ্যাপক জিন্নাত আরা নাসরিন।
আলোচক ছিলেন পিসিওবি’র পাবলিকেশন সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মরিয়ম ফারুকী, পিসিওবি’র সদস্য অধ্যাপক ডা. কামরুন্নেসা রুনা, অধ্যাপক ডা. শিউলী চৌধুরী, পিসিওবি’র সায়েন্টিফিক সম্পাদক অধ্যাপক ডা. নুসরাত মাহমুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক ডা. ফাতেমা রহমান, ট্রেজারার অধ্যাপক ডা. মারুফ সিদ্দিকি প্রমুখ।
ওয়েবিনারে সভাপতির বক্তব্যে পিসিওবি বাংলাদেশের সভাপতি মেজর (অব.) অধ্যাপক ডা. লায়লা আরজুমান্দ বানু বলেন, বিশ্বে ১১৬ মিলিয়ন নারী ও কিশোরী পিসিওএস রোগে ভুগছেন। দিনকে দিন রোগী বাড়ছেই। আগে যেখানে প্রতি ১০ জনে একজন আক্রান্ত ছিলেন; এখন সেখানে প্রতি সাতজনে একজনের পিসিওএস শনাক্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, গবেষকরা রোগটি বেড়ে যাওয়ার জন্য বেশকিছু কারণ সামনে এনেছেন। তবে প্রধান কারণ জেনেটিক্যাল ও লাইফস্টাইল। অনেকেই মাত্রাতিরিক্ত বসে থাকে, একদম হাঁটা-চলা করে না। ফাস্ট ফুড বেশি খান। এ জন্য তিনি ডায়াবেটিসে আত্রান্ত হন। আর ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় দেখা দিচ্ছে পিসিওএস। বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে আশার কথা, চিকিৎসার ফলে রোগটি থেকে মুক্তির হার আশাব্যাঞ্জক। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করতে হবে।
প্রধান অতিথি পিসিওবি বাংলাদেশের জাতীয় উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. টি এ চৌধুরী বলেন, মানুষের তো অসুস্থতার সীমা নেই। এখন এতকিছু থাকতে পিসিওএস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে কেন? কারণ, রোগটি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মৃত্যু হয় না। ধীরে ধীরে মানুষের হরমোন পরিবর্তন করে দেয়, যার সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ে নারীর জীবনে। যেহেতু সমস্যার শুরু কিশোরী বয়সে, সে জন্য রোগটি যাতে না বাড়ে- সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তাহলে রোগটি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
তিনি বলেন, গ্রামের অনেক মেয়ে আমাদের কাছে আসে, যাদের মাসিক অনিয়মিত। দেখা যায়- তারা অনেকেই মুটিয়ে গেছে, খাবারে অরুচি। বিবাহিত হলে সন্তানধারণ বাধাগ্রস্ত হয়। হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে এসব জটিলতা দেখা দিয়েছে। কারণ হরমোনের ভারসাম্যের সঙ্গে ওজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। ওজন কমাতে পারলে আপনা-আপনি হরমোনের ভারসাম্য ফিরে আসে। তখন পিসিওএস নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়ে যায়। যদিও কথাটা বলা যত সহজ, মেনে চলা অত সহজ না।
পিসিওবি’র জাতীয় উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, আজকাল গ্রামে-গঞ্জেও অতিরিক্ত ওজনের কিশোরী মেয়েদের দেখতে পাওয়া যায়। সম্প্রতি গ্রামে গিয়ে এমনটা দেখতে পেয়েছি। আমার দেখা মেয়েটার শরীরেও লোম ছিলো। তার মার কাছে জানতে চাইলাম, অল্প বয়সেই মেয়েটা কেন এতটা মুটিয়ে গেল? জবাবে মা জানালো, ‘সে খুব একটা খায় না। তারপরও ওজন বেড়েই চলেছে। তবে, সে অনেক বেশি বিছানায় কাটায়। বেলা করে ঘুমায়।’
তো আমরা দেখতে পাচ্ছি- আজকাল গ্রামের মেয়েরাও অলস জীবন-যাপন করছে। ঢাকা কিংবা অন্য শহরগুলোর মতো গ্রামেও ফাস্টফুড খাওয়া হচ্ছে। তবে, শুধু খাবার আর লাইফ স্টাইলের কারণেই মেয়েরা কেবল পিসিওএস এ আক্রান্ত হচ্ছে না। জেনেটিক্যাল কারণও অনেক বড় একটা ফ্যাক্টর। আগে যেমন আমরা বলতাম, মোটা হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আমরা রোগীর ইতিহাস ঘেঁটে দেখছি। জানতে পারছি, তার মা-নানী কিংবা দাদীরাও অতিরিক্ত মোটা ছিলেন। তাই, সময় থাকতে সচেতন হতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শমাফিক নিয়ম মেনে জীবনযাপন করতে হবে। না হলে চরম কষ্টের জীবন বয়ে বেড়াতে হবে তাদের। আমাদের মায়েদের অবশ্যই ছোট বাচ্চাদের জোর করে অতিরিক্ত খাওয়ানোর অভ্যাস ছাড়তে হবে। এতে তারা মুটিয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে পিসিওএস এর মত ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই পরিবারের প্রত্যেক মাকে এ ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন হতে হবে। কিশোরী মেয়েদেরকে পিসিওএস এর মত দীর্ঘমেয়াদী ভয়াবহ রোগ থেকে বাঁচাতে আমাদের সবাইকে এ বিষয়ে আরও বেশি বেশি কথা বলতে হবে। সবার মাঝে তা ছড়িয়ে দিতে হবে।
পিসিওবি’র পাবলিকেশন সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মরিয়ম ফারুকী বলেন, আমার আলোচনা হচ্ছে- পিসিওএস এর ভয়াবহতা নিয়ে আমরা কেন সচেতনতা তৈরি করবো? কাদেরকে করবো? কাদের জন্য করবো?
এ বিষয়ে প্রথম কথা হলো, অসুস্থ শিশুদের নিয়ে মায়েরা যখন আমাদের চিকিৎসকদের কাছে যান, তখন কিন্তু তাদেরকে সংশ্লিষ্ট রোগের পাশাপাশি বাড়তি ওজন থাকলে সেটা নিয়েও কথা বলতে হবে। এটা ঠিক যে, শিশুদের স্বাস্থ্য ভাল থাকলে- তাদের দেখতে সুন্দর লাগে। কিন্তু অতিরিক্ত ওজন হলে তা যে চরম ক্ষতির কারণ- সেটা অভিভাবকদের বলতে হবে। শিশু যেন কিছুতেই বেশি মুটিয়ে না যায়। কারণ ফ্যাট সেল একবার তৈরি হয়ে গেলে ভবিষ্যতে সে আরও বেশি মুটিয়ে যাবে। তাহলে আমরা প্রথমে মাকে সচেতন করবো। তবে, মায়েরা যাতে কিছুতেই কিশোরী মেয়েকে দোষারোপ বা আঘাত দিয়ে কথা না বলেন- সে বিষয়ে সতর্ক করে দিতে হবে।স্কুলের শিক্ষকদেরকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এরপর পরিবারের অন্য সদস্যদেরকেও এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
পিসিওবি’র সায়েন্টিফিক সম্পাদক অধ্যাপক ডা. নুসরাত মাহমুদ কথা বলেন পিসিওএস এ আক্রান্ত নারীরা সন্তান ধারণের আগে কিভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেন- সে বিষয়ে। তিনি বলেন, সন্তান ধারণের জন্য পিসিও হোক আর নন-পিসিও হোক, সব মেয়েদেরই শারীরিক ও মানসিক প্রস্ততি প্রয়োজন। এটা অত্যন্ত বড় দায়িত্বও বটে। পিসিও মেয়েদের একটা বড় সমস্যা হলো অনিয়মিত মাসিক হওয়া। সাধারণত এসব মেয়েদের ওজনটা একটু বেশি থাকে। তাই তাদেরকে জীবন-যাপনে পরিবর্তন আনতে বলি। নিয়মিত শারীরিক চর্চা ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে বলি। কিছু ওষুধও খেতে বলি। কারো কারো ডায়াবেটিস থাকে। সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখার নির্দেশিকা দেই। সেইসাথে মাসিক নিয়মিত হওয়ার জন্য হরমোন দিয়ে থাকি।
বাচ্চা ধারণের প্রস্তুতি হিসেবে তাদের মানসিক পরিচর্যা অবশ্যই অতি জরুরী। পিসিও মেয়েদের একটা ভয় থাকে- আমরা আদৌ বাচ্চার মা হতে পারবো কি-না। এই প্রশ্নটা পিসিও মেয়েটার পাশাপাশি তার মায়েরাও করে থাকেন। তাদের আশ্বস্ত করে বলি- যথাযথ নিয়ম মেনে সন্তান ধারণ সম্ভব, ইন-শা-আল্লাহ।
পিসিওবি’র ট্রেজারার অধ্যাপক ডা. মারুফ সিদ্দিকি কথা বলেন- ‘পিসিওএস আক্রান্ত নারীরা বাচ্চার মা হতে পারবেন কি-না’- এ প্রসঙ্গে। তিনি জানান, অনেক নারী বাচ্চা ধারণে অক্ষম হয়ে পড়েন। অথচ তারা জানেনই না যে, তারা পিসিওএস এ আক্রান্ত। একটা-দু’টা বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকের কাছে যান। তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রোগটি ধরা পড়ে। সাধারণত: পিসিওএস আক্রান্তদের হরমোন তারতম্যের কারণে ডিম্বাণু নিষিক্ত হয় না। আশার কথা হলো- এই সমস্যা কাটানোর জন্য চমৎকার চিকিৎসা রয়েছে। এই চিকিৎসার জন্য খুব ভালমানের ওষুধপত্র আমাদের হাতে রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওষুধগুলো খুব ভাল কাজ করে। যাদের ওষুধে কাজ হয় না, তাদেরকে আমরা ইনজেকশন প্রয়োগ করি। অনেক রোগী আছেন, যারা খুবই হতাশ হয়ে পড়েন। এক কথায় তাদেরকে বলবো- ওজনটা নিয়ন্ত্রণ করুন। কারণ সঠিক চিকিৎসায় পিসিও নারীরাও সন্তান ধারণ করতে পারবেন। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই।
পিসিওবি’র সদস্য অধ্যাপক ডা. শিউলী চৌধুরী বলেন, পিসিও নারীরা সন্তান ধারণের আগে যেমন নিয়ম মানবেন- তেমনই সন্তান ধারণের পরও সমানভাবে সতর্ক থাকবেন। কারণ তাদের অ্যাবরশন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এসময় ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। প্রি-এক্লামশিয়া তথা প্রেগন্যান্সিতে ব্লাড প্রেসার বেশি হওয়া, সেইসাথে প্রি-টার্ম ডেলিভারির আশঙ্কা থাকে। এ বিষয়গুলো তাদের জানাতে হবে।
পিসিওবি’র সদস্য অধ্যাপক ডা. কামরুন্নেসা রুনা জানান, পিসিওএস নারীরা কেউ একজন সন্তান নিতে চাইলে- সম্ভাব্য সমস্যা নিয়ে তাকে আগে থেকেই সচেতন থাকতে হবে। এজন্য প্রথমেই তাকে লাইফস্টাইল বদলাতে হবে। এর মানে হলো- তাকে ওজন নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম বা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ, ডায়েট কন্ট্রোল বা খাদ্যাভ্যাস বদল এবং নিজের আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। এ বিষয়গুলো বলা যতটা সোজা, মেনে চলাটা অত সোজা না। তবে সন্তান ধারণে সফল হতে চাইলে অবশ্যই বিষয়গুলো কঠোরভাবে পালন করতে হবে।
সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক ডা. ফাতেমা রহমান কথা বলেন পিসিও নারীদের চিকিৎসার ফলোআপ বিষয়ে। তিনি বলেন, অধিকাংশ পিসিও নারী ৩টা পর্যায়ে চিকিৎসকদের কাছে আসেন। প্রথমে কিশোরী বয়সে আসেন- যখন ওজন বেড়ে যায় এবং মাসিক ঠিকমত হচ্ছে না- তখন। দ্বিতীয়ত: এলোমেলো মাসিক ও সন্তান ধারণ করতে পারছেন না- তখন। মেনপোজ বা মাসিক যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখনও পিসিও নারীদেরকে আমাদের ফলোআপে আসতেই হয়।
তিনি বলেন, কিশোরী মেয়েরা যখন প্রথমে আসেন, সে সময় বাবা-মাকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, মেয়ের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের জন্য নিয়মিত ফলোআপে আসতে হবে। কারণ, তারা মনে করেন যে, একমাস ওষুধ খেলে কিংবা ডায়েট চার্ট ফলো করলেই একেবারে সুস্থ হয়ে যাবে। এ সময় রোগী ও বাবা-মাকে ভালভাবে কাউন্সিলিং করতে হবে। যাতে তারা নিয়মিত ফলোআপে আসেন। কারণ এ সময় ঠিকমত ওষুধ খেলে এবং জীবনধারণের সঠিক নিয়ম-কানুন মেনে চললে পরবর্তীতে তার সন্তান ধারণে কোন ধরনের সমস্যা হবে না। এরপর সন্তান ধারণের সময়ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে তাকে চলতে হবে। তাহলে তার ও সন্তানের কোন সমস্যা হবে না। এরপর মাসিক বন্ধের পরও তাকে ফলোআপে আসতে হবে। কারণ এ সময় তাদের স্তন ক্যান্সার বা জরায়ুমুখের ক্যান্সারের মত মরণব্যাধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সৌজন্যে— রেনেটা লিমিটেড