খাদ্য উৎপাদনে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন জরুরি

2021-02-15 21:41:20
খাদ্য উৎপাদনে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন জরুরি

খাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদা। বর্তমানে খাদ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ’নিরাপদ’ অভিধান। কৃষিবিদদের সমন্বিত গবেষণা এবং প্রচেষ্টায় সামগ্রিক কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের ফলে খাবারের ঘাটতি পূরণ হয়েছে। কিন্তু খাবারের মান এবং নিরাপত্তা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কৃষকের ভূমিকা যতটা, তার চেয়ে কৃষিবিদের ভূমিকা কোনও অংশে কম নয়।

১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় কৃষিবিদ দিবস উপলক্ষে ডক্টর টিভি আয়োজন করে বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান ‘নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কৃষিবিদদের ভূমিকা’। আলোচনায় অংশ নেন ‘ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার’ গাজীপুর এর ডিরেক্টর ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম ও বাংলাদেশ অ্যানিমেল এগ্রিকালচার  সোসাইটর প্রেসিডেন্ট কৃষিবিদ মো. মোর্শেদ আলম। সঞ্চালনায় ছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন

ডক্টর টিভি: খাদ্যের উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষিবিদদের ভূমিকা কী?

ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম: আমরা যখন স্বাধীনতা অর্জন করি তখন আমাদের জনসংখ্যা ছিলো সাড়ে সাত কোটি। কিন্তু খাদ্যা ঘাটতি ছিলো প্রায় ২০ লক্ষ টন। প্রতিবছরই সেসময় খাদ্যাভাবে মানুষ মারা যেত। দুর্ভিক্ষ ছিলো নিত্যসঙ্গি। আজকে ১৮ কোটি জনগণ, তার পরেও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই সময়ে বাংলাদেশ এক তৃতীয়াংশ কৃষিজমি হারিয়েছে। এর পরেও খাদ্য নিরাপত্তার এই অর্জন। এটা হয়েছে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে। এর মধ্যে বাংলাদেশ এমন কিছু নিজস্ব প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে যা সত্যিই অভাবনীয়। প্রযুক্তির সঙ্গে কৃষকের পরিচিতি করানোর ক্ষেত্রে কৃষিবিদদের ভূমিকা ছিলো অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ডক্টর টিভি: আমরা খাদ্য উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করেছি। কিন্তু নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে আমরা কতোটা সক্ষম হচ্ছি?

কৃষিবিদ মোর্শেদ আলম: আমাদের সক্ষমতাগুলো অনেকধাপ এগিয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির সময় আমরা অনুধাবন করেছি যে, স্বাস্থ্য এবং কৃষিতে এখনও আমাদের মারাত্মক ঘাটতি আছে। খাদ্য নিরাপত্তা অতি উচ্চারিত কিন্তু জটিল একটি ব্যাপার। খাদ্য নিরাপত্তার দু’টি দিক। একটি পরিমাণগত, অন্যটি পুষ্টিমানগত। আমরা পরিমাণগতভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে আমাদের এখনও ঘাটতি আছে, সেটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে।

ডক্টর টিভি: সামনের দিনগুলোতে আমাদের কোন ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে? এজন্য কৃষিবিদদের ভূমিকা কি হতে পারে?

ডা. তোফাজ্জল ইসলাম: খ্যাদ্য উৎপাদনে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। জনসংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, কিন্তু কৃষিজমি কমছে। আমরা এখন পর্যন্ত কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে ইনপুট করতে হচ্ছে। যেমন, এক কেজি চাল উৎপাদন করতে চার হাজার লিটার পানি খরচ হচ্ছে। এর বাইরে রাসায়নিক সার বা বালাইনাশক যতটা ব্যবহার করছি তাতে কৃষকের লাভ থাকছে না। এজন্য কৃষিকে লাভজনক অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে। এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য কৃষিবিদদের আরও বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। প্রযুক্তি পরিবর্তনশীল, তাই কৃষিবিদদের প্রযুক্তিতে আরও বেশি পারদর্শি হতে হবে। বায়োটেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ন্যানো টেকনোলজি বিষয়গুলোকে নতুন করে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকার পাশাপাশি কৃষিবিদদেরও ভূমিকা নিতে হবে।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং মাঠে কৃষকের মধ্যেমে সেগুলোকে ব্যবহার করাতে হবে। এজন্য  সরকরি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আমরা সমাগ্রিকভাবে কৃষিতে উন্নতি করছি। আমরা সবুজ বিপ্লবের কথা বলছি, সেটা বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন স্বাধীনতার পরে। পৃথিবীর অন্যদেশগুলো আরও আগে শুরু করেছিলো। আমাদের সবুজ বিপ্লবের লক্ষ্য অনেকটাই অর্জিত হয়েছে। কিন্তু আমরা মাটির স্বাস্থ্য হারিয়ে ফেলেছি। এই মাটির বা উদ্ভিদের স্বাস্থ্যের উপর আমাদের স্বাস্থ্য অনেকটা নির্ভরশীল। এজন্য আমাদের অর্গানিক উপায়ে খাদ্য উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। বায়োটেকনোলজি গবেষণা আরও বেশি বাড়াতে হবে। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ এখন সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার বাড়াতে হবে।

ডক্টর টিভি: উপাদানের দিক থেকে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করেছি। কিন্তু নিরাপদ খাদ্যের জন্য সরকারি-বেসরকারি কি কি উদ্যোগ দরকার?

কৃষিবিদ মোর্শেদ আলম: এই মুহূর্তে আত্মতৃপ্তির জায়গা এখনও তৈরি হয়নি। বিজ্ঞান একটি পরিবর্তনশীল বিষয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিবর্তন হয়। সেক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশের থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমরা যদি থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম বা তাইওয়ানের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে আমরা এখনও শিশু। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আমাদের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি  অতিরিক্ত কিটনাশক ব্যবহার। ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রয়ের জন্য সরকারি অনুমোদন দরকার। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন দরকার, কিন্তু কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিটনাশকের যথেষ্ট ব্যবহার হচ্ছে। এক্ষেত্রে কৃষিবিদদের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কিটনাশক বিক্রির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ দরকার। এজন্য সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে।

অন্য আরেকটি সেক্টর পোলট্রি শিল্প। এখানে আমাদের অনেক সফলতা এসেছে। বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত মাংসের ৬০ শতাংশ আসে পোল্ট্রি থেকে। আমরা বছরে ৪০ বিলিয়ন ডিম উৎপাদন করি। ২০১৩ সালে জনপ্রতি ডিম খাওয়ার পরিমান ছিলো ৩৭টি। এখন সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১শ’৪টি। এই উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখাশোনার ক্ষেত্রে সরকারি কোনো নীতিমালা বা আইন নেই।

খামার প্রক্রিয়ায় সরকারি কোনও নীতিমালা নেই। একটি ভবন নির্মাণে অনেকগুলো সরকারি অনুমোদন দরকার। কিন্ত একটি খামার স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনও নীতিমালা বা প্রক্রিয়া এখনও হয়নি। যদিও সরকার উভয়ক্ষেত্রেই ঋণ দেয়। কিন্তু একটি জায়গায় সরকারি নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হয়। অন্যটির ক্ষেত্রে তার বিপরীত। এখানে যদি কৃষিবিদের পরামর্শ বা উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে একদিকে সরকারি অর্থায়ন নিরাপদ হবে, অন্যদিকে কৃষিবিদদের বেকার সমস্যার সমাধান হবে।

ডক্টর টিভি: গবেষণা খাতে বিনিয়োগ খুব কম হয় বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ। এ ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?

ডা. তোফাজ্জল ইসলাম: কৃষিখাতে গবেষণায় বড় সফলতা আমাদের আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে। তবে আগামীদিনের কৃষি গবেষণা যেটাকে আমরা লাভজনক কৃষি বলছি, সেটার জন্য এখনই কাজ শুরু করতে হবে। এর জন্য অনেক বেশি বিনিয়োগের দরকার হবে। কৃষি এখন লাভজন খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আগেকার দিনে কৃষক তার উৎপাদন থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশ বিক্রি করতো। আমরা যারা কৃষিখাতে উৎপাদন করতাম না তারা সেটাই কিনে খাইতাম। সে যায়গায় এখন বড় ধরণের পরিবর্তন এসেছে। এখন শুধু বিক্রি করার জন্য এবং ব্যবসা করার জন্যই উৎপাদন করা হচ্ছে। এখন আমাদের গবেষণা হতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিক। জলবায়ু পরিবর্তন মাথায় রাখতে হবে, এছাড়া মাটির স্বাস্থ্য দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত জমির পরিমান কমে যাচ্ছে।  এসব বিষয় মাথায় রেখেই আগামী দিনের কৃষি কেমন হবে, তা ঠিক করতে হবে।

শুরুতেই ভূমি ব্যবহার আইন করতে হবে। যে জমি যে কাজের জন্য উপযুক্ত তা সে কাজেই ব্যবহার করতে হবে। এজন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। এখন পর্যন্ত যা গবেষণা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ সরকারি বরাদ্ধে। কিন্তু এখন সময় এসেছে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত গবেষণার। কারণ, অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান কৃষি ব্যবসার সঙ্গে এখন জড়িত। সমন্বিত গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান উদ্ভাবন করতে হবে এবং নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য প্রযুক্তিবিদদেরকে প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমাদের উৎপাদিত খাদ্যগুলো এখন মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি করে। এর কারণ হচ্ছে, খাদ্যগুলো নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ নেই। যার কারণে মানুষ সহজে বিশ্বাস করতে পারছে না। আমাদের অনেক খাবার নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় কাজ করে। গবেষণার মাধ্যমে এই সব সংশয় দূর করতে না পারলে, আমাদের সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে।

ডক্টর টিভি: নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ভোক্তা হিসেবে কোন বিষয়গুলো খেয়াল করা দরকার?

কৃষিবিদ মোর্শেদ আলম: সাধারণ ভোক্তাগণের উদ্দেশ্যে আমি এতটুকু বলতে চাই, আপনারা সচেতন হবেন, কিন্তু অতি সচেতন হয়ে বিভ্রান্ত হবেন না। আমাদের ক্রয় ক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই চাহিদা নিরুপণ করতে হবে। আমি বলতে পারি, আমাদের খাদ্যের মান যথেষ্ট নিরাপদ আছে। আমাদের পোল্ট্রি এবং ডিম অন্য যেকোনে দেশের তুলনায় নিরাপদ। কিন্তু এটা আরও বেশি নিরাপদ করার চেষ্টা করতে হবে।

ডক্টর টিভি: ডা. তোফাজ্জল ইসলাম এবং কৃষিবিদ মোর্শেদ আলম আপনাদের দু’জনকেই ডক্টর টিভির পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ।


আরও দেখুন: