ব্ল্যাক ম্যাজিক, স্কোপোলামিন এবং ধুতরা ফুলের বিষক্রিয়া
ব্ল্যাক ম্যাজিক, স্কোপোলামিন এবং ধুতরা ফুলের বিষক্রিয়া (ইনসেটে ডা. সাঈদ এনাম)
ধুতরা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম এট্রোপিয়া বেলাডোনা (Atropa Belladona)। বেলাডোনা (Belladona) শব্দটি ইতালিয়। বেলা 'Bella' অর্থ সুন্দরী আর ডোনা 'Dona' শব্দের অর্থ 'রমণী'। অর্থাৎ 'সুন্দরী রমণী'। তৃতীয় বা চতুর্দশ শতকের দিকে ইতালিয় রানীরা নিজেদের চোখ এবং ত্বক'কে আকর্ষণীয় করতে ধুতরা ফলের রস চোখ ও ত্বকে ব্যবহার করতেন। এট্রোপিন (Atropine) থাকায় নাম এট্রোপা (Atropa)।
ধুতরার ফলের 'Atropine' যা চোখের মনি'কে বড়ো করে ( Dialated Pupil) ফলে চোখ চকচকে, মোহণীয়, এবং অপেক্ষাকৃত বড় দেখায়। আর ত্বকে ব্যবহার ত্বক হয় মসৃণ, নরম। রানী ক্লিওপেট্রা (Cleopatra) চোখের সৌন্দর্যে ধুতরা ব্যবহার করতেন বলে অনেক ঐতিহাসিক বলেন।
তবে দীর্ঘ ব্যবহারে এট্রোপিন এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় চোখ নস্ট হয়ে যায় বলে পরবর্তীতে এর ব্যবহার কমে আসে।
ধুতরার এমন ব্যবহারে উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস ধুতরার বৈজ্ঞানিক নাম দেন এট্রোপা বেলাডোনা (Atropa Belladona)।
ধুতরা পাতা ও ফলের উপাদান হলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান হলো 'স্কোপোলামিন'। এই 'স্কোপোলামিন'কে নিঃশ্বাসের সাথে নিলে বা ত্বকের মাধ্যমে শোষিত হয়ে রক্তে মিশে দ্রুত ব্রেইনে পৌছে সাময়িক সময়ের জন্যে মানুষের ব্রেইন অকেজো হয়ে যায়। এতে মানুষ বোকার মতো হয়ে যায় (Stuporous Condition), বিবেক বুদ্ধি বিবেচনা হারিয়ে ফেলেন (Loss of Cognitive power)।
ক্ষেত্রবিশেষে তীব্র বিষক্রিয়ার প্রভাবে রোগী অনেক সময় উন্মাদের মতো শুরু আচরণ করতে পারেন। তার মধ্যে নানান সাইকিয়াট্রিক সিমটম (Symptoms) যেমন হ্যালুসিনেশন (Hallucination), ভ্রান্ত চিন্তা-ডিলিউসন (Delusion), গায়েবী শক্তির অধিকারী ভাবা (Delusion of Possession) অগোছালো কথাবার্তা (Disorganized Speech), অগোছালো কাজ (Disorganized Behaviour)।
অনেকের ধারণা ধুতরায় যেহেতু স্কোপোলামিন (Scopolamine) আছে এবং এটা সহজ লভ্য তাই শত্রুতা বশত: বন্ধুরুপী শত্রু অসৎ উদ্দেশ্যে নিয়ে অনেক সময় ধুতরা ফলের রস খাবারে মিশিয়ে দেয়। ফলে রসে থাকা ক্ষতিকর স্কোপোলামিন রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে সে অত্যন্ত বাধ্য আচরণ করে, তার বিবেক বুদ্ধি, বিবেচনা লোপ পায়, অনেক ক্ষেত্রে উন্মাদের মতোও আচরণ করে। অজ্ঞতার আর কুসংস্কার এর জন্যে এ অবস্থাকে সহজ সরল মানুষ একে যাদু-টুনা মনে করেন আর দুস্টু ভন্ড কবিরাজ, ভন্ড মোল্লা, তান্ত্রিক এর সুযোগ নেয়। একে ব্ল্যাক 'ব্ল্যাক ম্যাজিকে' বলে চালিয়ে দেয়।
এমন কি ভন্ড তান্ত্রীক, ভন্ড সাধক, কবিরাজ, ভন্ড পীর, 'যাদু-চালান' বা 'ব্ল্যাক ম্যাজিক' এর নামে ধুতরার ফলের গুড়া, বা বোতলে পানির সাথে 'রস' দিয়ে বলে 'টার্গেট' (স্বামী, স্ত্রী, প্রেমিক, বা প্রেমিকা) কে খাইয়ে দিতে। ফলে ভিকটিম খানিকটা স্টুউপারাস (Stuperous) হয়ে যায়, উন্মাদের মতো আচরণ করে।
ধুতরার স্কোপোলামিনকে কেনো শয়তানের নিঃশ্বাস বলা হয়?
ধুতরার স্কোপোলামিন দ্রুত ব্রেইনের 'ব্লাড ব্রেইন বেরিয়ার' (Blood Brain Barrier-BBB ) নামে একটি ছাকুনি বা পর্দা দিয়ে প্রবেশ করে আমাদের ব্রেইনের পৌছে যায়, ফলে ব্রেইনের কোষ তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা সাময়িক সময়ের জন্যে হারিয়ে ফেলে। এতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে যায়, আক্রান্ত রোগীর মাঝে নানান সাইকিয়াট্রিক সিমটম (প্স্যছিয়াত্রিচ Symptoms) যেমন হ্যালুসিনেশন (Hallucination), ভ্রান্ত চিন্তা-ডিলিউসন (Delusion), গায়েবী শক্তির অধিকারী ভাবা (Delusion of Possession) অগোছালো কথাবার্তা (Disorganized Speech), অগোছালো কাজ (Disorganized Behaviour), (Cognitive Impairment) দেখা দেয়।
এতে রোগী রোবটের মতো একান্ত বাধ্য আচরণ করে ক্রিমিনালের সকল আদেশ নিষেধ মানতে থাকে। সেই সুযোগে ক্রিমিনাল সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে নেয়, এমনকি শ্লীলতাহানিও করে। ক্রিমিনালদের প্রধান টার্গেট থাকে কিশোরী,তরুণী, নারী। এজন্য একে শয়তানের নিঃশ্বাস বলে।
দেহ থেকে স্কোপোলামিন বের হবার পর রোগী ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারেন। তবে বিষক্রিয়ার পরিমাণ বেশী হলে প্ভিকটিম মারা যেতে পারে। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন, আছে রোমান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট সম্রাট অগাস্টাস (Augustus) কে ধুতরা পয়জনিং করে উন্মাদ বানিয়ে হত্যা করেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী লিভিয়া (Livia)।
এসব কারণেই স্কোপোলামিনকে শয়তানের নিঃশ্বাস বা ডেভিলস ব্রেথও বলা হয়।
লেখকঃ
ডা. সাঈদ এনাম
এম বি বি এস (ডিএমসি) এম ফিল (সাইকিয়াট্রি)
ব্রেইন, স্নায়ু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
সহকারী অধ্যাপক,
সিলেট মেডিকেল কলেজ।
ইন্টারন্যাশনাল ফেলো, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।