ভাইটির যায়গায় তো আমিও থাকতে পারতাম
ডা. এজাজ বারী চৌধুরী
॥ ১ ॥
প্রায় ২৫ বছর আগের কথা৷ তখন আমি ঢাকা মেডিক্যালের ফার্ষ্ট ইয়ারের ছাত্র৷ একদিন কমনরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় আচমকা ডাকে ফিরে তাকালাম৷
"এক্সকিউজ মি, আমি ঢাকা মেডিক্যালেরই ছাত্র৷ বর্তমানে একটু সমস্যায় আছি৷ আপনার কাছে একটু help চাচ্ছি৷ কিছু টাকা হবে?"
ছোটখাট গড়নের মানুষটির দিকে ভালোভাবে তাকালাম৷ কাঁচাপাকা, রুক্ষ, শুষ্ক চুলগুলো যত্ন করে আঁচড়ানো৷ জীর্ণ, রঙচটা, ফ্যাকাশে শার্টটি ভালোভাবে ইন করা৷ চামড়া ওঠা বেল্ট, ছেঁড়া জুতার মধ্য থেকে বেরিয়ে থাকা মোজা - সবকিছুই যেন তার অতীত আভিজাত্যের প্রতি ব্যঙ্গ করছে৷
ঢাকা মেডিক্যালের সিনিয়র ভাই এরকম হবে, বিশ্বাস হলোনা৷ ভাবলাম, ভিক্ষা করার নিত্য নতুন ফন্দি বের করা প্রতারকদের একজন৷ রাগও হলো, ক্যাম্পাসের ভেতর এসে আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে দেখে৷ সরে আসলাম সেখান থেকে, কিছু না দিয়েই৷
॥ ২॥
এরপর প্রায়ই তাঁকে দেখতাম, সেই একই পোশাকে (শার্ট ইন করা, বেল্ট-জুতা পরা) কলেজের সামনের চত্বরে বা ক্যান্টিনের সামনে বা কমনরুমের সামনে৷ বিরক্ত হতাম, লোকটা এরকম প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে দেখে৷
একদিন তিনি আবার আমার কাছে সাহায্য চাইলেন৷ তখন বেশ চড়া সুরেই বললাম, বলেনতো ফার্ষ্ট ইয়ারে কি কি subject আছে? অপ্রস্তত হয়ে গেলেও, তিনি বলতে পারলেন৷ আমি মনে বড়ো একটা ধাক্কা খেলাম৷
॥ ৩ ॥
বহু বছর ধরে কমনরুমে চাকরি করা বৃদ্ধ শরীফ ভাইয়ের দ্বারস্হ হলাম৷ জিজ্ঞাসা করলাম, ওই ভাইটির সম্পর্কে কিছু জানেন, যিনি এখানে সাহায্য চেয়ে বেড়ায়? উনি কি আসলেই এখানকার student?
শরীফ ভাই বললেন, উনি আসলেই এখানকার৷ ছাত্র থাকাকালীন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন৷ চিকিৎসাও করা হয়েছে অনেকদিন, কিন্তু উনি আর সুস্হ হননি৷ উনার বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন এখন এখানেই বড়ো পজিশনে আছেন বা প্রফেসর হয়ে গেছেন৷ কিন্তু কেউই তাকে আর কোন সাহায্য করেন না৷ নিরুপায় হয়ে কলেজের ছাত্রদের কাছেই কেবল উনি সাহায্য চান, বাইরে কোথাও না৷
আমি মুগ্ধ হলাম, মানসিক ভারসাম্যহীন একটা মানুষের আত্মসম্মানবোধের ভারসাম্য দেখে৷
॥ ৪ ॥
ইচ্ছে ছিলো, একটু সামর্থ্য হলেই ভাইটির জন্য কিছু করবো৷ কিন্তু কয়েক বছর পর, আচমকা তিনি উধাও হয়ে গেলেন৷ সম্ভবত তখন আমরা থার্ড ইয়ারে পড়ি৷ ক্যাম্পাসের বাকি দিনগুলোতে অবচেতন মনে তাকে খুঁজতাম৷ তাঁর ভাবনা মনে আসলেই খুব কষ্ট পেতাম আর আফসোস হতো - কেন উনার জন্য কিছু করিনি৷ একটু মানসিক সাপোর্ট দেয়া, একটু গল্প করা, অন্তত একবার একবেলা একসাথে খাওয়া, এমনকি একটু সম্মান দেখানোও তো হয়ে ওঠেনি আমার৷
সেই কষ্ট আর অনুতাপ দিন দিন শুধু বেড়েই গেছে.... তাঁর অসহায়ত্ব আর আমার উপেক্ষাকে উপলব্ধি করে৷ এজন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনা৷
॥ ৫ ॥
ভাইটির এলেমেলো জীবন এবং দূর্ভাগ্য, আমার জীবনটাকে গুছিয়ে রাখতে অনেক বেশি সাহায্য করেছে৷ সবাই যেখানে নিজের থেকে এগিয়ে যাওয়া মানুষদের দিকে তাকিয়ে হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বা নিজেকে ব্যর্থ ভাবে, সেখানে আমি ভাইটির কথা মনে করে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করি৷
যখনই আমার জীবনকে কোন বড়ো হতাশা এসে গ্রাস করে, তখনই কল্পনা করি, ওই ভাইটির যায়গায় তো আমিও থাকতে পারতাম.... সঙ্গীহীন, সংসারহীন, আপনজনহীন, অর্থহীন, সম্মানহীন, ভালোবাসাহীন! হতাশার মেঘ কেটে যায়, কষ্ট তখন বিলাসিতা মনে হয় .... আর মনে হয়, My Life is Beautiful.