পিসিওএস হটাতে সবাইকে সচেতন হতে হবে

ডক্টর ডেস্ক
2022-09-30 23:04:34
পিসিওএস হটাতে সবাইকে সচেতন হতে হবে

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (পিসিওএস)

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা ডিজিজ মেয়েদের এক জটিল রোগ যা হরমোন এবং মেটাবলিক ডিসঅর্ডারের এক কঠিন সমাহার। জেনেটিক কারনেও এ কঠিন সমস্যাটি হতে পারে। এজন্য বংশ পরম্পরায় মেয়েদের মাঝে স্থুলতা ও পিসিওএসের সমস্যা দেখা যায়। আজ পর্যন্ত এ সমস্যার জটিল প্যাথফিজিওলজিটি সম্পূর্ণ ক্লিয়ার নয়।

কিশোরী কালে মানে বয়ঃসন্ধির সময়টাতে এটি ধরা পড়ে, কখনও খানিকটা পরেও আসতে পারে। ঋতুস্রাবের অনিয়ম, মুটিয়ে যাওয়া, শরীরে ও মুখমন্ডলে অবাঞ্ছিত লোম, ব্রণ, ঘাড়ে কালো দাগ ইত্যাদি এ রোগের প্রধান উপসর্গ। মুটিয়ে যাওয়াই এর কারন, নাকি এটি হওয়ার কারনেই মেয়েরা মুটিয়ে যায়, তা এখনও প্রশ্নবোধক।

মস্তিস্কের হাইপোথলামাস পিটুইটারি এক্সিসের কোথাও ঘাপলার কারনে গোনাডোট্রপিন হরমোন এফএসএইচ এবং এলএইচ এর নিঃসরণ বাড়তে থাকে, ফলে ইস্ট্রোজেন নিঃসরণও বাড়ে, এলোমেলো এ হরমোনের প্রভাবে ডিম্বাশয়ে বা ওভারিতে একই সাথে অনেকগুলো ফলিকল বড় হতে থাকে, কিন্তু একটিও ডিম্বাণু বা ওভাম তৈরী করা বা তা নিঃসরণের যোগ্য হয় না। আধাআধি মেচিওর ফলিকল গুলো ডিমও দিতে পারে না, চলেও যায় না, বরং পরিবর্তিত হয়ে ছোটো ছোটো সিস্ট তৈরী করে এবং ডিম্বাশয়ের কর্টেক্সের পেরিপেরিতে মালার মতো সাজানো থাকে। এ থেকেই নামটি হয়েছে পলিসিস্টিক, মানে একসাথে অনেকগুলো সিস্ট।
ডিম্বাশয়ের কর্টেক্স বা বহিঃত্বক ভারী বা পুরু হয়ে যায়, যার কারনে ডিম্বাণু কখনও সখনও তৈরী হলেও তা ভেদ করে বাইরে আসতে পারে না। দু'পাশের ওভারিতেই একই ঘটনা ঘটতে থাকে এবং ওভারির ভলিউম বেড়ে যায়। ওভুলেশন মানে ডিম্বাণু তৈরী হয় না বলে পিরিয়ডে অনিয়ম হয়, যখন পিরিয়ড হয় তখন বেশী এবং প্রলম্বিত রক্তপাত হয়, তবে এর উল্টোটাও হতে পারে। কখনও পিরিয়ড অনেকদিন বন্ধ থাকে। ডিম্বাশয়ের পরিবর্তন গুলো পেলভিক আলট্রাসাউন্ডে ধরা পড়ে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই।

মেয়েলি হরমোনগুলোর তারতম্যের কারণে রক্তে এন্ড্রোজেনিক (পুরুষালি) হরমোন বেড়ে যায়, যার কারণে বডি এবং ফেসিয়াল হেয়ারের আধিক্য দেখা দেয়, ত্বক তৈলাক্ত হয় ও ব্রণের উৎপাত বাড়ে। অপরদিকে বাড়তে থাকে ইনসুলিন হরমোনের রেজিস্টেন্স, মানে ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। এতে কার্বোহাইড্রেট মেটাবলিজমে বিঘ্ন ঘটে এবং স্থুলতা বাড়তে থাকে। তবে মাঝেমাঝে নিয়মিত ওজনের মেয়েদেরও পিসিওডিতে ভুগতে দেখা যায়। ইস্ট্রোজেনের আধিক্যে নিগেটিভ ফিডব্যাকের মাধ্যমে পিটুইটারি থেকে নির্গত হরমোন এফএসএইচ তুলনামূলক ভাবে কমে যায় এবং এল এইচ বেড়ে যায় এবং এন্ড্রোজেনিক হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়।

অনেক দিন পর পর ঋতুস্রাব, স্বল্প, অনিয়মিত বা অতিরিক্ত ব্লিডিং এসব নিয়েই মায়েরা প্রথম অবস্থায় মেয়েদের নিয়ে আসেন। কেউ কেউ দেরী করে আসেন যখন বিবাহের পর কাঙ্খিত সন্তান আসে না। সন্তান ধারণে দেরী বা বন্ধ্যাত্ব, গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়া, গর্ভকালেও হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, মুটিয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানাহ সমস্যা চলতেই থাকে। এদের অনেকেরই পরবর্তীতে টাইপ টু ডায়াবেটিস দেখা দেয়। রোগীর বর্ণনা, ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা, পেলভিক আলট্রাসাউন্ড এবং রক্তে হরমোনের পরিমাপের মাধ্যমে রোগটি নির্নয় করা যায়।
এছাড়া অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেনের প্রভাবে জরায়ুর লাইনিং এপিথেলিয়াল কোষ বাড়তে থাকে, তা থেকে অনিয়মিত প্রচুর রক্তপাত এবং ভবিষ্যতে জরায়ু ক্যান্সার (এন্ডোমেট্রিয়াল হাইপারপ্লাসিয়া / এন্ডোমেট্রিয়াল কারসিনোমা) দেখা দিতে পারে। কাজেই পিসিওএসে এর রোগীদের সবসময় ফলো আপে রাখতে হয়। বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার ক্ষেত্রে ওজন কমানোর পাশাপাশি ইনসুলিন রেজিস্টেন্সের জন্য মেটফরমিন এবং ওভুলেশান ইনডিউসিং ড্রাগ (ডিম্বানু ফোটানোর ঔষধ) দেয়া হয়ে থাকে, নিবিড় ও নিয়মিত ফলো আপে রাখতে হয় গর্ভধারণের আগে ও পরে।

তবে এই জটিল রোগে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা প্রথম ও প্রধান চিকিৎসা। এজন্য ছোটবেলা থেকেই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ফ্রক পরা নাদুসনুদুস মেয়ে বাচ্চা দেখতে যতোই মায়াবী লাগুক না কেনো, পরিমিতভাবে বাচ্চাটির ওজন বাড়ছে কিনা সেটা কঠিন ভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। ওজন কমার সাথে সাথে রোগীর পিরিয়ডের সমস্যাগুলো দূর হতে থাকে, রক্তে হরমোনের ব্যালেন্সও চলে আসে। তাই নিয়মিত শরীরচর্চা, জাঙ্কফুড পরিহার, জীবনাচারে পরিবর্তন, নিয়ম করে হাঁটা, পরিমিত আহার ইত্যাদির ব্যাপারে সকলকে সচেতন হতে হবে এবং অপরের সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে।

সারাবিশ্বে পিসিওডি রোগীর সংখ্যা প্রচুর, প্রায় ১১৬ মিলিয়ন নারী ও মেয়ে এ জটিল সমস্যায় ভোগছে এবং দিনদিন তা বেড়েই চলছে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে সেপ্টেম্বর মাসকে পিসিওডি সচেতনতা মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, সারা মাস জুড়ে দেশে বিদেশে বিভিন্ন সভা সেমিনার ও গণ সচেতনামূলক কার্যক্রম চলছে। আমাদের দেশে এ রোগের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য গাইনোকোলজিস্টদের পিসিওবি নামে একটি সংগঠনও রয়েছে, বিভিন্ন মিডিয়ায় তাঁরা মাসজুড়ে কাজ করে যাচ্ছেন। 


আরও দেখুন: