মেরুদণ্ডে টিউমার হয়েছে, বুঝবেন কীভাবে
রাতের বেলায় কিছুক্ষণ ঘুমানোর পরই ব্যথার জন্য জেগে ওঠে এবং সকালেও প্রচণ্ড কোমরের ব্যথা হয়
মস্তিষ্কের (ব্রেন) টিউমার নিয়ে আলোচনা বেশি হওয়ায়, এটি সম্পর্কে মানুষের কমবেশি ধারণা রয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় এদেশে মেরুদণ্ডের (স্পাইনাল কর্ড) টিউমার নিয়ে জানাশোনা একটু কমই।
মেরুদণ্ডে টিউমার হলে কী ধরনের সমস্যা দেখা দেয় এবং কখন বুঝবেন আপনি আক্রান্ত, এ বিষয়ে ডক্টর টিভিকে সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত বলেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. সৌমিত্র সরকার।
তিনি বলেন, প্রথমে জানা দরকার টিউমার কি? টিউমার মানে একটি নিউ গ্রোথ। শরীরের কোথাও স্বাভাবিক টিস্যুর পরিবর্তে অস্বাভাবিক (অ্যাবনরমাল) কিছু তৈরি হয়, সেটিকে টিউমার বলা হয়। মেরুদণ্ড হচ্ছে আমাদের শরীরের পেছন দিকের লম্বা হাড়, যেখানে একেকটি ভার্টিব্রা বা কশেরুকা পরস্পরের সাথে ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্কের মাধ্যমে লাগানো থাকে। এই পুরো ভার্টিব্রাল কলামটার মধ্যে গর্তের মতো একটি ভার্টিব্রাল ক্যানেল আছে। সেদিক দিয়ে স্পাইনাল কর্ড ও কিছু নার্ভ রুট যায়। এটার উপরে একটা কাভারিং আছে, যেটা স্পাইনাল কর্ড ও নার্ভ রুটগুলোকে সুরক্ষা দেয়, যেটিকে আমরা ড্যুরা মেনিনজেস বলে থাকি।
মেরুদণ্ডের এ গঠন চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারব, কোথায় টিউমার হলে, সেটিকে আমরা মেরুদণ্ডের টিউমার বলব। মেরুদণ্ডের ভেতরে যে স্পাইনাল কর্ড বা সুষুম্নাকাণ্ড রয়েছে, সেই স্পাইনাল কর্ডের ভেতরে টিউমার হতে পারে। স্পাইনাল কর্ডের বাইরে ও মেনিনজেস বা কাভারিংটার ভেতরে যে জায়গা আছে, সেখানে টিউমার হতে পারে। অথবা কাভারিংটার বাইরে যে স্পেস আছে, ওখানেও টিউমার হতে পারে। অথবা ভার্টিব্রাল কলাম অর্থাৎ বাইরে যে হাড়টা আছে, সেখান থেকে টিউমার হতে পারে। সবগুলো মিলেই মেরুদণ্ডের টিউমার বলা হয়।
কেন মেরুদণ্ডে টিউমার হয়
ডা. সৌমিত্র সরকার বলেন, মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের টিউমার একই ধরনের। এগুলো হওয়ার সঠিক কারণ এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে ধরে নেয়া হয়, এখানে কোনো জিনগত প্রবণতা (জেনেটিক্যাল প্রিডিস্পোজিশন) রয়েছে। জিনগত কোনো কারণে রূপান্তর (মিউটেশন) হয়ে অথবা কোনো একটা জিনের ত্রুটির জন্য এ রোগগুলো হচ্ছে। পরিবারে টিউমার থাকলে পরবর্তীতে জেনেটিক্যালি কারও স্পাইনাল টিউমার হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেউ যদি দেখা যায় হঠাৎ করে কানে কম শুনছেন, আস্তে আস্তে কানে শোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং সাথে একটা স্পাইনাল টিউমার দেখা দিল। এ উপসর্গগুলোকে বলি নিউরোফাইব্রোমেট্রিস-টু। নিউরোফাইব্রোমেট্রিস-ওয়ান আছে একটা, নিউরোফাইব্রোমেট্রিস-টু আরেকটি। নিউরোফাইব্রোমেট্রিস-টুতে স্পাইনাল কর্ড টিউমারের সাথে সিপি এঙ্গেল টিউমারস, প্রগ্রেসিভ হিয়ারিং লস হয় ইত্যাদি জড়িত থাকে।
তিনি বলেন, আরেকটি উপসর্গ রয়েছে, আমরা ভন হুইপলস লেন্ড্রো ডিজিজ বলে থাকি। এক্ষেত্রে একটি বাল্কি অরগান টিউমার হয়। দেখা গেছে, কোনো রোগীর রক্তনালিতে টিউমার হয়েছে, কিডনির টিউমার হয়েছে, সেই সাথে অ্যাড্রেনালিন গ্ল্যান্ডের টিউমার হয়েছে। এই টিউমারগুলোর সাথে অনেকক্ষেত্রে স্পাইনাল কর্ড টিউমার হয়ে যায়। এক সাথে এতগুলা টিউমারস হলে বুঝে নিতে হবে এটি ভন হুইপলস লেন্ড্রো ডিজিজ সিম্পটোম। এক্ষেত্রে জেনেটিক্যাল প্রিডিস্পোজিশন অবশ্যই থাকে। দেখা গেছে, পরিবারের একজন সদস্যের মধ্যে এ রোগ থাকলে পরবর্তীতে আরেকজন সদস্যের বা পরবর্তী প্রজন্মে এগুলো দেখা দিতে পারে।
এছাড়া ব্রেইন টিউমারের ক্ষেত্রে যেমন, কিছু রেডিয়েশন হ্যাজার্ডস, অনেক বেশি রেডিয়েশন এক্সপোজার্স, বিভিন্ন ভাইরাস ইত্যাদি কারণ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু স্পাইনাল কর্ডের টিউমারের ক্ষেত্রে এ রকম সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই।
মেরুদণ্ডের টিউমারের উৎপত্তি
ডা. সৌমিত্র সরকার বলেন, মেরুদণ্ডের বাইরে থেকেও এসে টিউমারের উৎপত্তি হতে পারে। এক্সট্রা-ড্যুরাল টিউমারগুলার ক্ষেত্রে প্রাইমারি সাইট অব টিউমারস কিন্তু অন্য জায়গায়। এই ড্যুরার বাইরে বোনি টিউমারস হতে পারে এবং সেই বোনি টিউমারস গিয়ে স্পাইনাল কর্ডকে চাপ দিতে পারে। অথবা এখানে ভাস্কুলার যে ব্লাড ভেসেলসগুলা আছে, সেগুলো থেকে হেমানজিওব্লাস্ট বা অন্যকিছু দিয়ে টিউমার হতে পারে। কিন্তু দেখা যাবে, প্রাইমারি টিউমারটা অন্য জায়গায়। সেটি থাইরয়েডে হতে পারে, প্রস্টেটিক ক্যানসার হতে পারে, ব্রেস্ট হতে পারে, কিডনি হতে পারে, ব্রঙ্কাস বা লাঞ্চে হতে পারে। এসব জায়গার প্রাইমারি টিউমারস গিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, মেরুদণ্ডে আক্রমণ করে। সেক্ষেত্রে এই টিউমারগুলো সাধারণত কিন্তু ইন্ট্রা-ম্যাডুলারি বা স্পাইনাল কর্ডের ভেতরে বা ইন্ট্রা-ড্যুরাল এক্সট্রা-ম্যাডুলারিতে হয় না। এখানে মেইনলি হয় এক্সট্রা-ড্যুরাল মানে ড্যুরার বাইরে এই টিউমারগুলা সাধারণত জমা হয়।
মেরুদণ্ডের টিউমারের উপসর্গ
ডা. সৌমিত্র সরকার বলেন, স্পাইনাল টিউমারগুলো মেইনলি কোমরের ব্যথা নিয়েই প্রেজেন্ট করে। তাহলে কোমরের ব্যথা একটা খুব কমন উপসর্গ। যদিও কোমরে ব্যথা অনেক কারণেই হতে পারে। কোমরের ব্যথাটা পারসিস্টেন্ট এবং প্রগ্রেসিভ। অন্যান্য ব্যথা যেমন একটু কম-বেশি হয়, এ ব্যথা একটিভিটির সাথে তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। সাধারণত সবচেয়ে কমন পেইন হয় পিএলআইডির ক্ষেত্রে বা ভার্টিব্রাল বডির জয়েন্টে কোনো সমস্যা হলে। যদি আমরা মুভমেন্ট করি, তাহলে ব্যথাটা বেড়ে যায়। কিন্তু স্পাইনাল টিউমারে যে ব্যথা হয়, একটিভিটির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন, হাঁটা-চলা করলে ব্যথা বাড়ে না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যথা কমেও যায়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হচ্ছে, রাতের বেলায় এ ব্যথাটা খুব বেশি বেড়ে যায়। দেখা গেছে, পিএলআইডির ক্ষেত্রে যে ব্যথা হয়, সেটি বিশ্রাম নিলে অনেকক্ষেত্রে ভালো হয়ে যায় বা কমে যায়। রাতে ভালো করে ঘুম হলো, সকালবেলা দেখা গেছে ব্যথা কম। কিন্তু, স্পাইনাল টিউমারের রোগীরা রাতের বেলায় কিছুক্ষণ ঘুমানোর পরই ব্যথার জন্য জেগে ওঠে এবং সকালে প্রচণ্ড কোমরের ব্যথা নিয়ে জেগে ওঠে।
এ ছাড়া রোগীর হাঁটা-চলার অসুবিধা হয়। হাঁটতে গেলে পড়ে যায় বা একদিকে হেলে যায়। বিশেষ করে রাতের বেলায় এরা একেবারেই হাঁটতে পারে না। এদের সেনসরি এটাক্সিয়া হয় এবং হাঁটতে গেলেই পড়ে যায়। প্রগ্রেসিভ উইকনেস ডেভেলপ করে এসব রোগীর ক্ষেত্রে। অনেক সময় পায়ের দিকে টিংলিং বা নাম্বনেস দেখা যায়। আবার পায়খানা-প্রস্রাবের রাস্তায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। ব্যথা যদি প্রগ্রেসিভ অ্যান্ড পারসিসটেন্ট, নট অ্যাসোসিয়েট উইথ দ্য একটিভিটি এবং রাতের বেলায় বাড়ে— এ রকম হলে সন্দেহ করতে হবে যে রোগী স্পাইনাল টিউমারে আক্রান্ত।