ডায়াবেটিস রোগীকে অবশ্যই খাদ্য ব্যবস্থাপনা মানতে হবে: পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো
ইলিয়াস হোসেন
2024-08-06 18:13:00
ডায়াবেটিস রোগীর সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা (ইনসেটে ) মানতে হবে (নিউটিশনিস্ট আখতারুন নাহার আলো)
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে সঠিক খাদ্য ব্যবস্থা মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করলেন ডায়াবেটিস নিউট্রিশনিস্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি ও বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রাক্তন চিফ নিউটিশন অফিসার আখতারুন নাহার আলো। সম্প্রতি ডক্টর টিভির সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
নিউটিশনিস্ট আখতারুন নাহার আলো বলেন, ডায়াবেটিস সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারলেই এর ঝুঁকি থেকে বাঁচা সম্ভব্। এজন্য প্রয়োজন সঠিক খাদ্য ব্যবস্থা। ডায়াবেটিসের খাদ্য ব্যবস্থা মেনে চলা আজ আর কোন কঠিন বিষয় নয়। প্রতিটি ডায়াবেটিস সম্পন্ন লোকের খাদ্য তালিকা পৃথক হয়ে থাকে। খাদ্য তালিকা তৈরি করতে গেলে একজন পুষ্টিবিদকে রোগীর পছন্দ-অপছন্দ, খাদ্যাভ্যাস, আর্থিক সঙ্গতি, কাজের ধরণ, ডায়াবেটিসের মাত্রা অথবা শারীরিক অবস্থা, খাবারের সময়, নারী-পুরুষ ভেদ, ওজন, উচ্চতা, বয়স সবকিছু বিবেচনায় এনে তৈরি করতে হয়।
পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো বলেন, ডায়াবেটিস রোগীকে কোন নির্দিষ্ট খাবার খেতে বাধ্য করা হয় না। তবে চিনি, মিস্টি গ্লুকোজের ক্ষেত্রে কোন আপোষ নয়। এই উপাদানটি একেবারে ত্যাগ করতে হবে। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি এড়াতে হলে অবশ্যই এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ডায়াবেটিস রোগীর খাবার হবে স্বাস্থ্য-সম্মত। অর্থাৎ সুষম খাবার থেকে হবে। যে খাবারে থাকবে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন ও মিনারেলস। কিছু বিষয় মনে রাখলে খাবার মেনে চলা সহজ হবে।
যেমন:
১. বিভিন্ন খাবার খাওয়া যাবে। একই ধরনের খাবার প্রতিদিনই না খেয়ে মাঝে মাঝে খাবারে ভিন্নতা আনতে হবে। এতে যেমন খাবারে যেমন বৈচিত্র্য আসবে, তেমনি একঘেয়েমিও লাগবে না। পালাক্রমে শর্করাযুক্ত খাবার যেমন- ভাত, রুটি, চিড়া, মুড়ি, খৈ, পাস্তা ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। প্রতিদিন প্রতিবেলায় ভাত, রুটি না খেয়ে খিচুড়ি, পরাটা, লুচি, পাস্তা, ফ্রায়েড রাইস, ভাত ভাজা খেলে কোন ক্ষতি নেই। কখনও চালের রুটি বা চিতই পিঠাও খাওয়া যেতে পারে। শুধু পরিমাণটুকু ঠিক রাখলেই চলবে। কারণ খাবারের পরিমাণ একদিন কম একদিন বেশি হলে সমস্যা হতে পারে। এতে রক্তে শর্করার মাত্রা কম-বেশি হতে থাকবে। যা মস্তিষ্কের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। খাবারের গ্লুকোজ যেমন শক্তি উৎপাদন করে, তেমনি এটা মস্তিস্কে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে।
২. ওজন:
দেহের ওজন সঠিক মাত্রায় রাখতে হবে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ওজন বেষি থাকতে দেখা যায়। আবার টাইপ-১ ডায়বেটিসের ক্ষেত্রে ওজন কম হতে পারে। এই জন্য উভয় ক্ষেত্রেই ক্যালরি গ্রহনের মাত্রা কমবেশি হবে। ওজন স্বাভাবিক থাকলে সব সময় যতটুকু খাবার খাওয়া হয়, সেই পরিমাণে খেলেই চলবে। আবার যদি ওজন কম বা বেশি হয়, পুষ্টিবিদের তৈরি করা খাদ্য তালিকা অনুসরণ করতে হবে।
৩. সঠিক পরিকল্পনা: খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। এর মধ্যে আসবে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সঠিক খাবার গ্রহণ এবং চাহিদামাফিক সঠিক মাত্রায় খাবার গ্রহণ। চিনি বা মিস্টি জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে। প্রতিদিন ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘন্টা পর পর দিনে ৫/৬ বার খাবার খেতে হবে। অর্থাৎ একটা শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হবে।
৪. ব্যায়াম ও ওষুধ: ডায়াবেটিসের ঔষধের সঙ্গে একটা সমন্বয় রেখে খাবার গ্রহণ ও ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়ামের বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি। খুব ভোরবেলা খালিপেটে এবং রাতে খাবারের পর ব্যায়াম বা হাঁটা উচিত নয়। এতে রক্তের শর্করা কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে- যা খুবই বিপজ্জনক। এদিকে রক্তে শর্করা বা রক্তচাপ খুব কম ও খুব বেশি থাকলেও ব্যায়াম বা হাঁটা উচিত নয়। প্রধান দুইটি খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে অথবা ভোরে হাঁটার পূর্বে হালকা কোন শর্করাযুক্ত খাবার খেয়ে হাঁটা উচিত। ঔষধের ক্ষেত্রেও চিকিৎকের পরামর্শ নিতে হবে।
৫. খাবার হতে হবে কম চর্বিযুক্তঃ খাবারে যেমন চর্বি কম থাকবে। তেমনি খাবারটি হতে হবে সম্পৃক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরলমুক্ত। তেল-মাখন-মার্জারিনে থাকে অল্প পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ লবণ। এসব খাবার কম খেলেও পুষ্টি পাওয়া যায়। তবে জমাট বাঁধা প্রাণীজ চর্বি খুবই কম খেতে হবে। কারণ এগুলো হৃদযন্ত্রের উপর খারাপ প্রতিক্রিয়া আনে।
বিভিন্ন উপায়ে খাবারে চর্বি কমানো যেতে পারে।
* ফুলক্রিম দুধ কম ও প্রাণীজ চর্বি বাদ দিতে হবে।
* আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, ফ্রেঞ্চফ্রাই এর পরিবর্তে আলু, বেগুন রান্না বা ভর্তা খেতে হবে।
* খেতে হবে চামড়া ছাড়ানো মুরগী, হাঁস, টার্কি ও কচি মাংস।
* ননস্টিক ফ্রাইপ্যানে মাখন-মার্জারিন-তেল-সালাদ ড্রেসিং এবং মাছ মাংসের ঝোল।
* ডুবো তেলে ভাজা খাবার কম পরিমাণে খাওয়া যাবে। এর পরিবর্তে খেতে হবে বেকিং, সিদ্ধ, ভাঁপানো, গ্রিল ও পোচ করা খাবার।
* কম ক্যালরির সালাদ, ড্রেসিং ও ফ্যাট ফ্রি দুধের দই খেলে ভাল হয়।
* ওজন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য সারাদিনের ক্যালরির ২৫-৩০ শতাংশ চর্বি খাবারে থাকতে হবে।
৬. খাদ্য আঁশঃ খাবারে পর্যাপ্ত আঁশ থাকা উচিত। এতে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ থাকবে। আঁশ রক্তের চর্বি কমাবে ও কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূর করবে। আঁশযুক্ত খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ায়। এ জন্য ময়দার চেয়ে আটা ও লাল চাল খাওয়া ভাল। সম্ভব হলে খোসাসহ ফল ও সবজি খাওয়া যেতে পারে।
৭. প্রতি সপ্তাহে অন্ততঃপক্ষে একদিন মাছ-মাংস বিহীন খাবার রাখতে হবে। এর পরিবর্তে খেতে হবে বিভিন্ন ধরনের বিনস্, মটরিশুটি ও সব ধরনের ডাল।
৮. লবণ বা সোডিয়ামঃ অতিরিক্ত লবণ রক্তচাপের মাত্রা বাড়ায়। ডায়াবেটিস সম্পন্ন লোকদের মধ্যে রক্তচাপ বেশি হওয়ার প্রবণতা থাকে। অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়িয়ে দেয়। যেমন- কিডনি রোগ।
যেভাবে খাবারে লবণ কম রাখা যায়-
* পাতে লবণ বাদ দিতে হবে এবং রান্নায় লবণ কমাতে হবে।
* টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবারে লবণ বেশি বলে এগুলো না খাওয়াই ভাল।
* লবনের পরিবর্তে সাদা ও কালো গোলমরিচ, লালমরিচ, লেবু, ভিনেগার, পুদিনা ও ধনেপাতা খেতে হবে।
৯. খুব বেশি ক্ষুধার্থ অবস্থায় খাবার না খাওয়াই ভাল। এতে রক্তে শর্করা ও ওজন দুটোই বেড়ে যায়।
১০. হলুদ ও ক্যাপসিকামে থাকে অ্যালকাইন ফসফেটাস- যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে। আবার কাঁচামরিচ ও দারুচিনিতে ইনসুলিন ক্ষরণ বেশি হয় বলে ডায়াবেটিস কম থাকতে দেখা যায়। এদিকে সফট ড্রিংকস ও অ্যালকোহলে প্রচুর ফ্রুকটোজ থাকে বলে রক্তের শর্করা বেড়ে যায়।
উপরোক্ত ১০টি বিষয় মেনে চললে স্বাস্থ্য যেমন সুরক্ষিত থাকবে, তেমনি ডায়াবেটিস এবং ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তবে খাবার গ্রহণের পূর্বে কি ধরনের উপাদান কত পরিমাণে ব্যবহার করা হয়েছে সে সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় রান্নার সময় চিনি, গুড়, চিনিযুক্ত সস, ঘনদুধ, নারিকেল ইত্যাদি মেশানো হয়। সেই খাবার খেলেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না। বিকল্প চিনি দিয়ে ঘন দুধের পায়েস খেলেও রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়।
ডায়বেটিসে খাদ্য ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যঃ
১. শরীরের রক্ষণাবেক্ষণ ও যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করা।
২. ওজন সঠিক মাত্রায় রাখা।
৩. শিশু-কিশোরদের বর্ধন ঠিকমত হওয়া, গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মায়েদের পুষ্টির ঘাটতি না হওয়া।
৪. রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা।
৫. ডায়াবেটিসের জটিলতা দূর করা। যেমন হৃদযন্ত্র, কিডনি, চোখ, স্নায়ুতন্ত্র ঠিক রাখা।
৬. কর্মঠ থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা।
যেভাবে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাবেনঃ
১. বাড়িতে গ্লুকোমিটারের সাহায্যে রক্ত পরীক্ষা করে ডায়াবেটিসের মাত্রা সব সময় পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
২. ধূমপান ত্যাগ করতে হবে।
৩. বছরে একবার চোখ পরীক্ষা করাতে হবে।
৪. স্বাস্থ্য সম্মত খাবার ও সুস্থ জীবনযাপন করতে হবে।
৫. নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে হবে।
৬. নিয়মিত ব্যায়াম ও ঘুমের প্রয়োজন।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে চারটি ধাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো- খাদ্য-ঔষধ-ব্যায়াম-শিক্ষা। ডায়াবেটিস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করাকে ঔষধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। কারণ যত বেশি রোগটি সম্পর্কে জানবেন, তত ভালভাবে একে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। ফলে স্বাস্থ্যগত জটিলতা থেকে দূরে ও নিরাপদ থাকা সম্ভব হবে। যেহেতু ডায়াবেটিস সারাজীবনের রোগ, সেজন্য এটাকে সঙ্গী করেই ভালভাবে বেঁচে থাকতে হবে বলে জানান নিউটিশনিস্ট আখতারুন নাহার আলো।