ডক্টর টিভিকে ডা. এনামুর রহমানের লাইভ সাক্ষাৎকার

অনলাইন ডেস্ক
2020-07-06 05:39:44
ডক্টর টিভিকে ডা. এনামুর রহমানের লাইভ সাক্ষাৎকার

ডা. এনামুর রহমান

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের দেশে আসছে। গত শুক্রবার (৩ জুলাই) ডক্টর টিভির বিশেষ আয়োজন 'বহুমুখী দুর্যোগে দেশ: মোকাবিলার কৌশল' বিষয়ে স্বাস্থ্যের অর্থনীতি অনুষ্ঠানে দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান, এমপি। এছাড়াও তিনি জানিয়েছেন বাঁধ নিয়ে নানা পরিকল্পনার কথা। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার (লাইভ) করা হয় ডক্টর টিভির ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে। লাইভ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক রেজাউল আজিম

ডক্টর টিভি: করোনা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ একসঙ্গে চলছে বাংলাদেশে। সরকারের মোকাবেলা কৌশল কী বা দেশ কতটুকু প্রস্তুত?

ডা. এনামুর রহমান: আপনারা দেখেছেন যে আমরা ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং ৩০ মে সেই ছুটি উইথড্র করা হয়।   এই যে টানা মার্চ  এপ্রিল মে করোনার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ, দিনমজুর, দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র এমনকি মধ্যবিত্তরাও সঞ্চয় ফুরিয়ে খাদ্য সঙ্কটে পরেছিলো।

সেসময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন এসব লোকদের তালিকা করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্য পৌঁছে দিতে হবে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা তালিকা করে প্রায় ৭ কোটি মানুষকে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছি। আর সেসময়ই ২০ মে আম্পান বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। আমরা আম্পানের সতর্কতা পেয়েছি ১৫ মে।  ১৫ থেকে ১৯ মের মধ্যে আমরা ১৪৭০০ আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করেছিলাম এবং ২৪ লাখ ৭৩ হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। তাদেরকে আমরা স্যানিটাইজার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ মাস্ক বিতরণ করেছিলাম। আম্পানে আমাদের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি, যদিও আমাদের অনেক ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, বাঁধ ভেঙে মাছের খামার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, আমের ক্ষতি হয়েছে, ফসল নষ্ট হয়েছে, পাটের ক্ষতি হয়েছে।

আরেকটা জিনিস এবার আমরা ৬ লাখ ২০ হাজার গবাদি পশুকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসায় গবাদি পশুর ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় নাই। এভাবে আম্পান মোকাবেলা করার পরে যখন ঝুঁকি শেষ হলো তখন মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছে।  আমরা জুনের প্রথম দুই সপ্তাহ ত্রাণকার্য চলমান রেখেছিলাম। তারপর যখন মাঠপর্যায়ে থেকে রিপোর্ট আসলো যে মানুষ কাজে ফিরে গিয়েছে এবং আর ত্রাণের প্রয়োজন নাই তখন আমরা ত্রাণ বিতরণ বরাদ্দ দেই নাই।

এরপর জুনের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে বন্যার পূর্বাভাস পেয়েছি। প্রথমে ৯টি জেলা, এরপর ১০টি, ১১টি এখন ১২টি জেলায় পানি বেড়েছে।

আর এই বন্যার কারণে আমরা কিন্তু আবার বন্যা কবলিত জেলা প্রসাশনের সাথে ভিডিও কলে মিটিং করে আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করার নির্দেশনা দিয়েছি।  জেলা প্রসাশন আমাদের জানিয়েছে, তাদের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে যা করোনার জন্য দেয়া হয়েছিলো। এছাড়া ২৮ মে এবং ২৯ মে নয়টি জেলায় নগদ টাকা এবং চাল সহায়তা দিয়েছি।

ডক্টর টিভি: অনেক ত্রাণ দিচ্ছেন যেটা অনেক ভালো। এই সময়ে মানুষের ইনকাম নাই, তারা খেতে পারছে না। এই সময়ে তাদেরকে দেয়া ত্রাণ অনেক হেল্প হচ্ছে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, করোনার সময়ে ত্রাণ বিতরণে কিছু অনিয়ম হয়েছে। ত্রাণের অনিয়ম বাংলাদেশে এর আগেও হয়েছে। ত্রাণ বিতরণে যেনো আর কোনো অনিয়ম না হয় সে ব্যাপারে টেকসই কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায় কি না কিংবা এমন কিছু করার চিন্তা করেছেন কি না আপনারা?

ডা. এনামুর রহমান: আপনি যে কথাটা বলেছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এই কথাটাই বারবার বলে থাকেন। ২৯ মার্চ তিনি আমাদেরকে নিয়ে এবং জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার, আইজিপি, র‌্যাবের ডিজি, আর্মড ফোর্সের পিএসও সহ মিটিংয়ে তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ত্রাণ নিয়ে যারা নয়-ছয় করবে তাদের ছাড় দেয়া হবে না। আপনি বলেছেন ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম হয়েছে কিন্তু আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ

মন্ত্রণালয় থেকে যেভাবে ত্রাণ দেয়া হয়েছে তালিকা করে প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়া হয়েছে। সেখানে কারো হাতেই খুব বেশি ত্রাণ দেয়া হয় নাই। তাই সেখানে অনিয়ম হয় নাই। অনিয়ম হয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওএমএসের দশ টাকায় চাল বিক্রি সেখানে হয়েছে, টিসিবির তেল নিয়ে হয়েছে এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভিজিডির চাল নিয়ে অনিয়ম হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জেলা প্রসাশক, বিভাগীয় কমিশনার, এমপি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইজিপি, সশস্ত্র বাহিনীর পিএসও নিয়ে মিটিঙ করে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের নির্দেশ দেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে যারা অন্যায় করেছে তাদের বরখাস্ত করা হয়। এই দ্রুত পদক্ষেপের কারণে দুর্নীতি কমে এসেছে।

আমরা বন্যার জন্য যে পূর্বাভাস পেয়েছি তার পরিপ্রেক্ষিতে কাজ শুরু করেছি। বন্যা মোকাবেলায় প্রতি জেলায়, উপজেলায় এবং ইউনিয়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে। ২০১৯ সালে এসওডি ( স্ট্যান্ডিং অর্ডার এন্ড ডিজাস্টার) এর জন্য স্থায়ী কার্যাদেশ সংশোধন করেছি। এছাড়া ওয়ার্ড ভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটিতে এমপি, চেয়ারম্যান, এনজিও, সুশীল সমাজ এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা থাকায় এখানে দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই।

ডক্টর টিভি: মাননীয় মন্ত্রী, দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে থাকে। আম্পানের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া বাধগুলো ৬০ বছরের পুরোনো। ওগুলোর মেয়াদও শেষ হয়েছে ২০ বছর আগে। পুরোনো বাধ দিয়ে কী বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডের মতো উন্নত বাধ দেয়ার ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?

ডা. এনামুর রহমান: এরকম দুর্যোগগুলোতে আমি এবং পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একসঙ্গে এসব এলাকা পরিদর্শনে যাই। সেখানে প্ল্যাকার্ড নিয়ে লোকজন বলে, ‘আমরা ত্রাণ চাই না, বাধ চাই’। এতে করে বুঝা যায় জনগণ বুঝেছে ত্রাণ নির্ভরতা কমিয়ে রিজিলিয়েন্স এম্বাকমেন্টে যেতে হবে।

আপনি যে নেদারল্যান্ডের কথা বললেন সেখানে আমি নিজে সেই বাধ পরিদর্শন করেছি। তার নাম আমস্টারডাম ড্যাম।সেটা একটা মেগাস্ট্রাকচারের মধ্যে পড়েছে। অসাধারণ একটা বাধ সেখানে আমি গিয়ে দেখেছি কিভাবে এই বাঁধ কাজ করে। আমি সব প্রোগ্রামে বলি, নেদারল্যান্ড হলো বাধ নির্মাণে মাস্টার। তাদের থেকে প্ল্যান এবং টেকনোলজি এনে উপকূলে বাধ দিলে রিজিলিয়েন্ট হিসেবে ঘোষণা দিতে পারবো। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও বলেছি প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে তাদের টেকনোলজি এন বাধ দেয়া দরকার।

পাকিস্তান আমলের এসব বাধ তৈরি করা হয়েছে। এরপর শুধু রিপেয়ার করা হয়েছে। সিডর, আয়লাতে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার পরেও ঠিক করতে পারে নাই।  ফনীর সময় আমি নিজে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি।  সেখানে বাধের যে দূরাবস্থা দেখেছি, বাধের উচ্চতা কম, প্রশস্ততা কম এগুলো বাঁধ হতে পারে না। আমরা ছোটবেলায় পড়েছি, চীনের দুঃখ হোয়াংহো। চীন সেই নদী যেভাবে শাষণ করেছে, যেভাবে বাঁধ দিয়েছে উচ্চতায় ৩০ ফিট এবং প্রশস্ততায় ৫০ ফিট। এবং সেখানে আরসিসি করে এমনভাবে হোল্ডার দেয়া হয়েছে যে সেখানে আর আগামী ১০০০ বছরের মধ্যে কোনো জায়গা প্লাবিত হবে না।

ডক্টর টিভি: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ডা. এনামুর রহমান: ডক্টর টিভি ও সকল দর্শক শ্রোতাদেরও ধন্যবাদ।


আরও দেখুন: