বিসিএস প্রিলিমিনারির প্রশ্ন: সমস্যাটা সিস্টেমের
বিসিএস প্রিলিমিনারির প্রশ্ন: সমস্যাটা সিস্টেমের
আমার বিসিএস পরীক্ষায় একটা প্রশ্ন ছিল যমুনা সেতুর পিলার কয়টি? কবি ভারতচন্দ্রের পিতার নামও এসেছিল। আমার সেগুলি মুখস্থ ছিল এবং ভালোভাবেই উত্তর দিয়ে এসেছিলাম।
উল্লেখ্য তখন আমি ইন্টার্ন ডক্টর। আমার অর্থপেডিকস ওয়ার্ড চলছিল। আমি খুব করে চাইছিলাম কিভাবে ভাঙ্গা পায়ে প্লাস্টার করে, কিভাবে পেঁচিয়ে পেচিয়ে শিল্পের মত ব্যান্ডেজ করে সেটা খুব ভালোভাবে শিখি। আবার একই সঙ্গে জানতাম এ কাজে বেশি মনোযোগ দিলে আমার বিসিএস হাতছাড়া হয়ে যাবে। সিনিয়ররা আমাদের শিখাতে মুখিয়ে ছিলেন, কিন্তু আমরা তখন বিসিএস গাইড হাতে লাইব্রেরীতে সাধারণ জ্ঞান, কবি-সাহিত্যিকদের পিতার নাম, যমুনা সেতুর পিলারের সংখ্যা, নেপোলিয়নের প্রেমিকার নাম মুখস্ত করতে থাকি। ফল হিসাবে একেবারে অপ্রয়োজনীয় মুখস্ত জ্ঞান দিয়ে বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করে যাই। আমার আর হাড় ভাঙ্গা রোগীদের প্লাস্টার করা শিখা হয় না- যদিও আমার মূল পেশাগত দায়িত্ব ছিল সেটা। আমি খুব করে চাইতাম ইস পরীক্ষাটা যদি প্লাস্টার, ব্যান্ডেজ, ইনফেকশন, নিউমোনিয়া এসবের উপর হতো! তাহলে আমার এই ওয়ার্ড ডিউটির নলেজ দিয়েই পরীক্ষা দিতে পারতাম, আমি আর রোগী দুপক্ষই বেঁচে যেতাম।
আজ এত বছর পর বিসিএস প্রিলিমিনারির প্রশ্ন দেখে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটের লাইব্রেরীতে যার যার নিজেদের সাবজেক্টের পড়াশোনা গবেষণা বাদ দিয়ে বিসিএস গাইড পড়ুয়াদের লাইন দেখে আমার আগের স্মৃতি মনে পড়লো। এতটা বছর পেরিয়ে গেল, অদ্ভুত ব্যাপার এই সিস্টেমের এতোটুকু পরিবর্তন হলো না। এই এতটা বছর ধরে কেউ একজনও ভাবেনি একজন চিকিৎসককে বা অন্য ক্যাডারে যারা চাকরি নিবে ভারতচন্দ্রের বাবার নাম কেন তাকে মুখস্ত করতে হবে? সাধারণ জ্ঞান তথা জেনারেল নলেজের নাম দিয়ে যৌবনের সবচেয়ে সুন্দর পর্বের এই সময় ও এনার্জিটুকু শোষণ করার অধিকার তাদের আছে কিনা। এই নলেজ কি আসলেই কোন নলেজের পর্যায়ে পড়ে?
বিসিএস পরীক্ষার জন্য আমার ট্রেনিং পিরিয়ডের সময়টায় রোগীদের কিছুটা বঞ্চিত করিনি, কাজে কিছুটা ফাঁকি দেইনি সে দাবি করব না। সেটা করেছি বলেই চাকরিটা পেয়েছি, তা না হলে হতো না। তা নিয়ে যে অনুশোচনা নেই তা ও বলবো না।
আমার অধ্যাপক স্যার আমরা যারা বিসিএসের গাইড হাতে নিয়ে হাফ মনোযোগ দিয়ে ওয়ার্ড ডিউটি করছিলাম- তাদেরকে বলেছিলেন, এসব করে তোমরা রোগীদের ঠকাচ্ছ। আজ শাহবাগের হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে এক কনফারেন্সে স্যারের সাথে দেখা।
মনে মনে বলি, স্যার সেদিন রোগীদের না ঠকালে আমি নিজেই ঠকে যেতাম। সমস্যাটা সিস্টেমের ছিল, আমার নয়।
তবে আবার যদি আমার জন্ম হয়, আবারও যদি একই সিস্টেমে বিসিএস পরীক্ষা দিতে হয় আমি একই কাজ করবো। চাকরিটা না হলে আমি খাবোটা কি? পরিবারকে দিবো টা কি? আমার পোস্ট গ্রেজুয়েশন করার খরচটা আসতো কোথা থেকে?
আমার মধ্যে তাই অনুশোচনা কাজ করেও আবার তা করে না। পদ্ধতিটা বদল করার ক্ষমতা তো আর আমার হাতে নেই। আর আমি যে জাতির অংশ সে জাতির পরীক্ষা পদ্ধতির দায়িত্বে যারা আছেন তাদের ভাবনাচিন্তার লেভেল পরিবর্তনের ক্ষমতাও তো আমার হাতে না।
লেখক :
ডা. আমিনুল ইসলাম
মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ।