ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
ঘরে ঘরে এখন মানুষের ডায়াবেটিস, আগে এমনটা ছিল না
ডায়াবেটিস কেন হয়, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণায় বড় ধরনের ভুল রয়েছে। ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে অনেককেই বলতে শুনি এবং পত্রপত্রিকায় ডায়াবেটিস সম্পর্কে অনেক নিবন্ধে অনেক ডাক্তারকে লিখতে দেখি, বংশগত কারণেও নাকি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
খুব গভীরভাবে দেখেছি, ডায়াবেটিস সম্পর্কে এমন বিশ্বাস বা বক্তব্যের কোনো বাস্তবতা নেই। একটা সময় ছিল, সমাজের পাঁচ শতাংশ মানুষেরও ডায়াবেটিস ছিল না। ডায়াবেটিস নামক কোনো রোগের সাথে মানুষের তেমন পরিচয়ও ছিল না। মানুষ শারীরিক পরিশ্রমের বিভিন্ন কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকতো। আর তখন মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের প্রায় সবগুলোতে কায়িক শ্রম ছিল। কায়িক শ্রম ছিল না, এমন কাজ তখন তেমন ছিলই না। মানুষ তখন একেবারে শেষ বয়সে যখন কাজকর্ম থেকে পুরো অবসরে চলে যেতো, তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো। যে সমাজে এক সময় ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা হাতে গোনা যেতো, সেই সমাজে এখন ডায়াবেটিসের এতো ছড়াছড়ি কেন? অবস্থা এমন পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে, অল্প ক’বছর পর হয়তো ৪০-৫০ বছরের বেশি বয়সী ডায়াবেটিসহীন মানুষ খুঁজে বের করাও কষ্টকর হয়ে পড়তে পারে। এখন শুধু বয়স্করা নয়, মধ্যবয়সী এবং তরুণরা নয়, শিশুরাও এখন বিশ^ব্যাপী ব্যাপকহারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে।
আমার এক আত্মীয়ের পরিবারে পাঁচ-পাঁচজন লোক ডায়াবেটিস রোগী! আমার এক সহকর্মীর চার বোনের মধ্যে তিনজনই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত! আমার এক বন্ধু আছে মামুন নামে। সে বললো, তাদের পরিবারে সে ব্যতীত তার বাবা-মা, ভাই-বোন (মোট ৭ জন) সবাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে! আমার বিশ্বাস, এরকম একই পরিবারে একাধিক মানুষের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার অনেক ঘটনা অনেকের জানা থাকতে পারে।
‘মহামারী রূপ নিচ্ছে ডায়াবেটিস’ শিরোনামে বিডি জার্নালে ১৪ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ‘ডায়াবেটিস মহামারী রূপ নিচ্ছে। দ্রুত নগরায়ণের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। আইডিএফের (আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন) ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৪২ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে।’ [https://www.bd-journal.com/health/95095]
চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও ডায়াবেটিস রোগী ছিল সমাজে দুর্লভ, আর এখন ঘরে ঘরে মানুষের ডায়াবেটিস, এটাই বাস্তবতা। যদি আগে অধিকাংশ মানুষের ডায়াবেটিস থাকতো, তাহলেই এখন বলা যেতো, ডায়াবেটিস বংশগত কারণে হয়ে থাকে। বিশে^র প্রায় সব দেশে এমন লক্ষ লক্ষ পরিবারে এখন অনেকের ডায়াবেটিস, যেসব পরিবারে আগে কারো ডায়াবেটিস ছিল না। তাহলে রোগটি কিভাবে বংশগত হলো? আমার বাবা-মা, দাদা-দাদী বা নানা-নানী কারোই ডায়াবেটিস ছিল না, অথচ আমার দু’ভাই ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসের শিকার হয়ে গেছেন কিভাবে!
বর্তমানে ৩৫ থেকে ৫০/৫৫ বছর বয়সী অনেক ডায়াবেটিস রোগীর পূর্বপুরুষেরও ডায়াবেটিস দেখেই ডাক্তাররা এবং সাধারণ মানুষ মনে করে বসে ডায়াবেটিস বংশগত রোগ। কিন্তু এদিকে লক্ষ্য করে না, বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের অধিকাংশেরই বাবা-মা বা পূর্বপুরুষ কারো ডায়াবেটিস ছিল না। ৩৫ বছরের বেশি বয়সী যারা এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের অনেকের পূর্বপুরুষের ডায়াবেটিস আছে দেখেই রোগটিকে বংশগত মনে করা যে ভুল, তা প্রমাণিত হবে বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের অধিকাংশেরই বাবা-মা বা পূর্বপুরুষের যে ডায়াবেটিস ছিল না, সেদিকে লক্ষ্য করলে।
‘মহামারী রূপ নিচ্ছে ডায়াবেটিস’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকেই স্পষ্ট, যত পেছনে যাওয়া যায়, দেখা যাবে তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তত কম ছিল। আইডিএফের হিসাব মতেই, ১৯৮৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। শুধু এই পরিসংখ্যান থেকেই প্রমাণিত হয়, ডায়াবেটিস কোনো বংশগত রোগ নয়। কারণ এখন এমন অনেক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যাদের পূর্বপুরুষরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল না।
এককথায় ডায়াবেটিসের কারণ যাদের নিকট পরিষ্কার, তারা কখনো ডায়াবেটিসকে বংশগত বলে বিশ্বাস করতে পারেন না। ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে শুরুতেই কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। আবারও আলোচনা করা হবে একটু পর। আমরা এখন দেখি, ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করায় কী ক্ষতি হচ্ছে?
প্রথম ক্ষতি :
ডায়াবেটিসের সত্যিকারের কারণ সম্পর্কে যাদের তেমন কোনো ধারণা নেই, তারাই এই রোগটির গায়ে বংশগত রোগের লেবেল লাগিয়ে দিচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। ভুল ধারণাটি এখনই দূর করা না গেলে ৫০-৬০ বছর পর মানুষের এই ধারণা দূর করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ এখন তো মানুষ অহরহ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। ৫০-৬০ বছর পর তখনকার প্রজন্মের কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে যখন সে দেখবে, তার পূর্বপুরুষরাও গণহারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, তখন সে নিশ্চিতভাবে রোগটিকে বংশগত রোগ মনে করবে। তখন এ ধারণা ভুল প্রমাণ করা অনেকটা অসম্ভব হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় ক্ষতি :
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলার কারণে কমপক্ষে দুই শ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
(১) যাদের এখনো রোগটি হয়নি, তারা যখন জানে রোগটি বংশগত, তখন দেখে নিজেদের বাবা-মা কারো রোগটি হয়েছে কিনা। যদি দেখে হয়নি, তখন তারা রোগটিতে আক্রান্ত হওয়া থেকে নিশ্চিন্ত থাকে, রোগটি প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করে না। এভাবে একসময় তারা রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, সত্যিকারার্থে যে কারণে মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হয়, সেই কারণেই।
(২) যেসব লোকের বাবা-মা কেউ রোগটিতে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে গেছে, তারা যখন জানে, রোগটি বংশগত, তখন তাদের মনে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, কখন তারা আবার রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে বসে! রোগটিতে আক্রান্ত হবার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা অপেক্ষা করতে থাকে। তাদের মনে সব সময় এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে। এই আতঙ্ক তাদের মন থেকে কোনোভাবে দূর করা যায় না এবং তারা মনে করে, রোগটি থেকে তাদের বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ নেই। তাই তারা রোগটি প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই করে না। কারণ রোগটি যে বংশগত! এভাবে একসময় তারাও রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এই দু’রকম ঘটনা এখন সমাজে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে শুধুই রোগটিকে বংশগত বলে অপপ্রচারের কারণে।
মানুষ কখন বংশতভাবে কোন রোগে আক্রান্ত হয়?
সন্তান গর্ভধারণের সময় থেকে শুরু করে মাতৃদুগ্ধ পানের সময় পর্যন্ত এই নির্দিষ্ট সময়ে বাবা-মা যেসব রোগে আক্রান্ত থাকেন, কেবল সেই সব রোগ সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। এক্ষত্রেও কথা আছে। যেসব রোগ রক্তবাহিত, কেবল সেগুলো একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। যেমন: এলার্জি, ক্যান্সার, বাতব্যথা বা আর্থারাইটিস ইত্যাদি। কিন্তু সন্তান গর্ভধারণের সময় থেকে শুরু করে মাতৃদুগ্ধ পানের সময় পর্যন্ত এই নির্দিষ্ট সময়ের পর বাবা-মা যদি কোনো রোগে আক্রান্ত হন, সেই রোগ সন্তানের শরীরে আপনা-আপনি সংক্রমিত হবার কোনো সুযোগ-ই নেই। তবে শুধু বাবা-মা যদি রোগটিতে আক্রান্ত অবস্থায় কখনো সন্তানকে রক্ত দিয়ে থাকেন, তখনই বাবা-মায়ের শরীর থেকে সন্তানের শরীরে সেই রোগ সংক্রমিত হতে পারে। রক্তদানের মাধ্যমে এই সংক্রমণকে কিন্তু বংশগত বলার সুযোগ নেই। কারণ যদি বাবা-মা কেউ তাদের সন্তানকে রক্ত না দিয়ে সেই রোগে আক্রান্ত অন্য কেউ তাদের সন্তানকে রক্ত দিতো, তাহলেও সন্তান সেই রোগে আক্রান্ত হতো।
আমার বয়স যখন ৩০ আর আমার বাবার বয়স যখন ৭০ বছর, তখন তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। আমার জন্মের ৩০ বছর পর আমার বাবা যেই রোগে আক্রান্ত হলেন, সেই রোগ যদি আমার শরীরে সংক্রমিত হতে পারে, তাহলে সমাজের যে কারো যে কোনো রোগ আমার শরীরে সংক্রমিত হতে পারবে। বংশগত রোগ নিয়ে এ এক চরম মূর্খতা।
ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে একটি সমীক্ষা :
ডায়াবেটিসকে যারা বংশগত ভাবতে বা বিশ্বাস করতে পছন্দ করেন, তাদেরকে একটি সমীক্ষা চালানোর অনুরোধ করবো। এখনো ঢাকা শহরে অসংখ্য রিকশাচালক পাবেন, যারা ‘পায়েচালিত’ রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আপনি এরকম রিকশাচালকদের সাক্ষাৎকার নিন।
তাদেরকে প্রথমে প্রশ্ন করুন- (১) আপনি কি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে রিকশা চালাচ্ছেন? যদি ‘না’ বলে, তাহলে তাদেরকে বাদ দিন। যারা ‘হ্যাঁ’ বলবে, তাদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করুন- (২) আপনি কি এই ২০ বছর রিকশা চালানোর মাঝে কোনো বিরতি দিয়েছেন? যদি ‘হ্যাঁ’ বলে, তাহলে তাদেরকে বাদ দিন। আর যদি ‘না’ বলে, তাদেরকে প্রশ্ন করুন, (৩) আপনি কি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ উত্তর প্রদানকারী ১০০ জনকে তৃতীয় প্রশ্নটি করলে দেখবেন, তাদের সবাই ‘না’ উত্তর দিচ্ছে। ২০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে ‘নিয়মিত’ বা ‘বিরতিহীন’ভাবে ‘পায়েচালিত রিকশা যারা চালান, তাদের কাউকে পাবেন না, যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
ডায়াবেটিস বংশগত কারণে হয় কিনা এবং ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ কী, এই দুইটি বিষয় যাচাইয়ের জন্য এই রকম একটা সমীক্ষা চালানোই যথেষ্ট। শুধু পায়েচালিত রিকশাচালক নয়, কায়িক শ্রমনির্ভর যে কোনো পেশায় নিযুক্ত মানুষদের উপর সমীক্ষা চালালেই একই রকম ফল বের হয়ে আসবে।
এরকম সমীক্ষা সহজেই প্রমাণ করবে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার মূল কারণ কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকা। একজন লোকের জন্মের সময় তার বাবা-মা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল না। তার জন্মের অনেক বছর পর তার বাবা-মা কেউ রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছেন কায়িক শ্রম থেকে দূরে সরে যাবার কারণে। সেই রোগটি তাকেও আক্রমণ করতে পারে সে-ও যদি কায়িক শ্রম থেকে দূরে সরে যায় উভয়ে একই কারণে রোগটিতে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও দুঃখজনকভাবে আমরা সন্তানের রোগটিকে বংশগত বলে আখ্যা দিচ্ছি।
কোনো রোগের সঠিক কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা না করে রোগটি রোগীর বাবা/মা কারো থাকার কথা জেনেই রোগটিকে বংশগত বলে ফেলা যে ক্ষতিকর, ডাক্তাররা তা বুঝতে পারলে কখনোই এভাবে মন্তব্য করতেন না।
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করে আমরা শুধু ভুল করছি না, পুরো মানবজাতির মারাত্মক ক্ষতিও করে যাচ্ছি। বংশগত রোগ মনে করার কারণে আমরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়াকে নিয়তির উপরই ছেড়ে দিয়ে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করছি না। অথচ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার প্রকৃত কারণটা আমাদের সামনে স্পষ্ট হলে তথা বেশি বেশি খাওয়া, মুটিয়ে যাওয়া এবং পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমহীন থাকার কারণে ডায়াবেটিস হয়, এই সত্যটা আমাদের উপলব্ধিতে এলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা আমাদের পক্ষে সহজ ও সম্ভব হতো।
নূর আহমদ : শিক্ষক; কলামিস্ট ও ফিটনেস বিষয়ক গবেষক
nurahmad786@gmail.com