জিরো ক্যালরির নামে নকল চিনি, কতটা নিরাপদ?
জিরো ক্যালরি
॥ জিরো ক্যালরীর নকল চিনি
জেনে শুনে বুঝে কিনি৷
Diet drinks, Diet খাবার
শরীর ভালো রাখে কি সবার? ॥
॥ ১ ॥
১৮৭৯ সাল৷ খনিজ আলকাতরা নিয়ে গবেষণা করছিলেন আমেরিকান বিজ্ঞানী ফালবার্গ৷ একদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে তিনি তার হাতে মিষ্টি স্বাদ পেলেন৷ এভাবেই আলকাতরা থেকে accidentally আবিস্কার হলো Zero Calorie চিনি বা Artificial চিনি বা নকল চিনি "স্যাকারিন" যা আসল চিনির চেয়ে প্রায় ৬০০ গুন মিষ্টি৷
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে চিনির সংকট দেখা দিলে, স্যাকারিনের চাহিদা বেড়ে যায়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো স্যাকারিনের চাহিদা ও গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়ানোর জন্য, ওজন কমানোর কার্যকরী উপায় হিসেবে স্যাকারিনের প্রচারণা শুরু করে৷ ফলে বিশ্বব্যাপী স্যাকারিনের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে৷ কোমল পানীয়, কেক, বিস্কুট, চকলেট, মিষ্টি, মিষ্টি খাবার, জুস, জেলী, আইসক্রিম এমনকি বিভিন্ন ঔষধেও স্যাকারিন ব্যবহার হতে থাকে৷ এবং এসব Sugar Free বা জিরো ক্যালরি খাবার এবং পানীয়গুলো খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷
স্যাকারিনের ব্যবসায়িক সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এরপর একের পর এক Zero calorie sugar বাজারে আসতে থাকে এবং তারা নিজেকে অন্যগুলোর চেয়ে আরো উন্নত, আরো নিরাপদ দাবি করতে থাকে৷ এগুলোর মধ্যে Aspartame এবং Sucralose আমাদের দেশে বেশি জনপ্রিয়৷ খাবার এবং পানীয়ে ব্যবহৃত এসব নকল চিনি, সত্যিকারের চিনি থেকে ২০০ থেকে ২০০০ গুন পর্যন্ত বেশি মিষ্টি হয়!
॥ ২ ॥
ওজন কমানো এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা - এই দুটো কারণেই মানুষ কৃত্রিম চিনি বা Zero ক্যালরি নকল চিনির প্রতি ঝুঁকেছে৷ কিন্তু এগুলো দীর্ঘমেয়াদে গ্রহণের ফলে বাস্তবে কি ঘটছে আমাদের শরীরের ভেতরে?
সমস্ত নকল চিনির প্রভাবকে আমরা ১) পেট - যার ভেতর এগুলো যাচ্ছে এবং ২) Brain যার নির্দেশে আমাদের শরীর পরিচালিত হয়, এদের response এর আলোকে ব্যাখ্যা করবো৷
॥ পেটের ভেতর ক্যালরিবিহীন নকল চিনির প্রভাব ও সম্ভাব্য ফলাফল॥
জেনে অবাক হবেন- ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস যেমন আমাদের শত্রু এবং বিভিন্ন রোগের কারণ আবার ঠিক ব্যাক্টিরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস দিয়েই আল্লাহ আমাদের শরীরের বিভিন্ন যায়গায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ এবং অতি প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদনের কারখানা তৈরী করে রেখেছেন৷
মুখ, পেট, ফুসফুস, চামড়া এবং যোনীপথে অবস্থিত এসব কারখানাকে বলে Microbiota. মজার ব্যাপার হলো- মানুষের Fingerprint যেমন একজনের সাথে আরেকজনের হুবহু মেলেনা, ঠিক তেমনই এই Microbiota গুলোও একেকজনের একেকরকম composition এ তৈরি৷ এজন্যই একেকজনের শরীরের সুস্থ থাকার ক্ষমতা কিংবা রোগাক্রান্ত হবার ধরন একেক রকম৷
মুখ থেকে পরিপাকতন্ত্রের পুরোটা জুড়ে আছে Gut Microbiota যেখানে শুধু ব্যাকটেরিয়াই আছে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন, যা আমাদের মোট দেহের কোষসংখ্যার দ্বিগুনেরও বেশি৷ ৷
খাবার হজম, পুষ্টি শোষণ, পরিপাকতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখা, ক্ষতিকর ভাইরাস-ব্যাক্টিরিয়া-ছত্রাকের আক্রমণ থেকে আমাদের শরীরকে রক্ষা করা, প্রয়োজনীয় ভিটামিন - এমাইনো এসিড - লিপিড তৈরী করা, বেশি ক্যালরী পুড়িয়ে শরীরকে সুঠাম রাখা, দেহের immune system বা সার্বিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ানো সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে এই Gut Microbiota.
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, Zero Calorie নকল চিনি গুলো এই microbiota কে পরিবর্তিত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত করে৷ ফলে কারো কারো শরীরের glycemic response পরিবর্তিত হয়। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরী হয়। শরীরের ওজন বেড়ে যায়। এমনকি ডায়াবেটিসও হতে পারে৷
॥ Brain এর উপর Zero ক্যালরী নকল চিনির প্রভাব ও সম্ভাব্য ফলাফল ॥
ক) Zero Calorie Sugar যুক্ত যেকোন খাবার আমরা যখন মুখে দিই, তখন তার মিষ্টি স্বাদে আমাদের Brain বিভ্রান্ত হয় এবং ইনসুলিন নিঃসরণ ঘটায় (Cephalic phase of insulin Secretion)৷ কিন্তু যেহেতু এটা চিনি নয়, তাই ইনসুলিন কোন কাজও খুঁজে পায়না৷ এভাবে দিনের পর দিন অতিরিক্ত ইনসুলিন নিঃসরণ হবার কারণে শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়, অর্থাৎ ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করেনা৷
খ) ক্যালরিবিহীন কোমল পানীয় বা চা-কফি যেটাই পান করা হোক না কেন, যেহেতু সেটা শরীরে ক্যালরির যোগান দেয়না, সেহেতু brain মানুষকে অন্য খাবার বেশি খাবার জন্য প্রলুব্ধ করে এবং এজন্যই তাদের ওজন কমার পরিবর্তে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে৷
গ) যেহেতু আমাদের Brain এ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, জিরো ক্যালরির সব নকল চিনি নিরাপদ, তাই এসব চিনিযুক্ত মিষ্টি খাবারের প্রতি মানুষের সংযম কমে যায় এবং বেশি বেশি খেতে থাকে৷ কিন্তু brain যখন বুঝতে পারে, এগুলো আসল চিনি নয়, তখন তার একমাত্র খাবার সত্যিকারের চিনি (glucose) খাবার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়৷ এভাবে নকল চিনি গ্রহনকারীদের Brain এর sugar craving বা মিষ্টি খাবারে আসক্তি দিন দিন বেড়েই চলে৷
ঘ) Artificial sugar এ অভ্যস্ত মানুষরা আস্তে আস্তে প্রাকৃতিক পুষ্টিকর মিষ্টি ফলগুলো খেয়েও তৃপ্তি পাননা, যেহেতু তাদের brain ভিন্ন রকম মিষ্টতাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়৷ এজন্য তাদের মনে ফলমূলের প্রতি অনীহা তৈরী হয় এবং পুষ্টিকর ফলগুলোর ভিটামিন ও মিনারেল থেকেও তাদের শরীর বঞ্চিত হতে থাকে৷
॥ ৩ ॥ অন্যান্য গবেষনায় খুঁজে পাওয়া নকল চিনির ক্ষতিকর প্রভাব ॥
মানবদেহে Aspartame, Sucralose এবং Acesulfame এই তিন রকম জিরো ক্যালরির নকল চিনির প্রভাব নিয়ে এক লক্ষেরও বেশি মানুষের উপর ফ্রান্সে একটি গবেষণা করা হয়৷ ২০০৯-২০২১ দীর্ঘ ১২ বছর ধরে চলে গবেষণা এবং ফলাফল বিশ্লেষণ৷
ফলাফলে পাওয়া যায়, যেকোন ধরনের নকল চিনি গ্রহনকারীদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে ১৩% - ১৪%৷ এদের মধ্যে Aspartame গ্রহণকারী মহিলাদের breast cancer এর ঝুঁকি বাড়ায় ২২%! (অর্থাৎ প্রতি ৫ জনে একজন আক্রান্ত হতে পারেন)৷
একই গবেষণায় আরো জানা যায়, নিয়মিত Diet Coke, Energy drinks, Diet Soda পানকারীদের Stroke এর ঝুঁকি বাড়ে ২৩%৷ এছাড়া, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, প্রেশার বেড়ে যাওয়া এবং হার্টের আর্টারি ব্লকের ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়৷ British Medical Journal এ এটা প্রকাশিত হয়েছে৷
॥ ৪ ॥ বিতর্ক এবং ব্যবসায়িক শক্তি॥
নকল চিনি এবং সেসব ব্যবহার করে পানীয় ও খাদ্য প্রস্তুতকারকদের ব্যবসায়িক শক্তি অপরিসীম৷ একবার USFDA প্রধান, স্যাকারিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে গেলে, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের রোষানলে পড়েন এবং চাকুরীচ্যুত হন৷ ১৯৭৭ সালে ইঁদুরে ক্যান্সার তৈরী করায় আবার স্যাকারিনের উৎপাদন নিষিদ্ধের চেষ্টা করে USFDA. কিন্তু এবারো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচারণা এবং কিছু মানুষের বিক্ষোভের মুখে সেটা পন্ড হয়ে যায়৷
এছাড়াও শতাধিক গবেষণাপত্র আছে, যেগুলোর ফলাফল এসেছে Zero Calorie নকল চিনিগুলো সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং মানবদেহের জন্য কোনরকম ক্ষতিকর প্রভাব এগুলোর নেই৷ দুর্নাম আছে, এগুলোর বেশিরভাগই প্রস্তুতকারক কোম্পানী গুলোর টাকায় পরিচালিত ফরমায়েশী গবেষণা৷ বিপরীতে অনেক কম সংখ্যক গবেষণায় এগুলোর ক্ষতিকর দিকগুলো উন্মোচিত হয়েছে৷
সুতরাং এসব নকল চিনি দিনে দিনে তাদের ব্যবসায়ে আরো চটকদার বিজ্ঞাপনী ভাষা যোগ করবে এবং এগুলোর উৎপাদন কখনোই বন্ধ হবেনা৷
স্বাস্থ্য আপনার, দায়িত্বও আপনার৷ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্বাস্থ্যের পাহারাদারও আপনি৷ সুতরাং জানুন, বুঝুন, নিজের Logic প্রয়োগ করুন এবং তারপর সিদ্ধান্ত নিন৷
https://www.cell.com/cell/fulltext/S0092-8674(22)00919-9...
(এখানে অনেক study link পাবেন৷ এছাড়া British Medical Journal এ প্রকাশিত French study, University of Texas এর study গুলোতে তথ্য পাবেন৷)