প্রসঙ্গ : ভাল ডাক্তার
ডাক্তার
প্রায়ই এক ধরণের পোষ্ট দেখি, "ঢাকার ভেতর একজন অভিজ্ঞ অমুক বিশেষজ্ঞ kindly সাজেস্ট করুন, যিনি সময় নিয়ে রোগি দেখেন৷"
"সময়" বিষয়টি এসব পোষ্টে অতীব গুরুত্ব পায়৷
সবচেয়ে বড়ো ট্রাজেডি এখানেই৷ সমাজে যারা অভিজ্ঞ বা বিখ্যাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন, তাদের সিরিয়াল পাওয়াটাই এখন রোগিদের সর্বোচ্চ অর্জন, বিজয় এবং সুখ৷ সেই ডাক্তারের চেম্বারের ভেতরের ২-৫ মিনিটের অভিজ্ঞতা সবার জন্যই স্বপ্নভঙ্গের এবং হতাশার৷
অবশ্য এটাও ঠিক, যিনি অভিজ্ঞ, সঠিক ডায়াগনোসিস এবং চিকিৎসায় তার সময় অবশ্যই কম লাগবে৷ তবে history নেয়া, examination করা, symptomps analysis করা, আগের চিকিৎসা যাচাই করা, টেষ্ট রিপোর্ট দেখা এবং মাথা খাটিয়ে অনেক সম্ভাবনার মধ্য থেকে সঠিক ডায়াগনোসিস বের করা যে কিছুটা সময় সাপেক্ষ, এটা অনস্বীকার্য৷
এবার ৩টি গল্প এবং সেগুলো থেকে আমি কি শিখেছি সেটা বলি৷
॥ ১ ॥
২০১৬ সালের কথা৷ আমার wife কে নিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালে গেলাম৷ আমার পছন্দের শ্রদ্ধেয় মালিহা রশীদ ম্যাডামের সিরিয়াল পেলাম না, বেশ কদিন অপেক্ষা করতে হবে৷ দ্বিতীয় বিখ্যাত ডাক্তারের সিরিয়ালের অবস্থাও প্রায় একই রকম৷ তাই বাধ্য হয়ে অন্যান্য ডাক্তারদের প্রোফাইল এনালাইসিস শুরু করলাম৷ গাইনী ডাক্তারদের বিশাল লিষ্ট৷ ১৩-১৪ জন বসেন৷ একাডেমিক প্রোফাইল সবারই প্রায় সমান হওয়ায় দ্বিধা গেলো আরো বেড়ে৷ শেষে সলিমুল্লা মেডিক্যালের একজন এসোসিয়েট প্রফেসর ম্যাডামকে দেখানোর সিদ্ধান্ত নিলাম৷
ম্যাডামের চেম্বারে প্রথমদিনই খুব অবাক হলাম৷ আমরা সহ মাত্র ৩ জন রোগি৷ ম্যাডাম প্রথম ভিজিট হিসেবে ভালোই আন্তরিক ছিলেন এবং সময় দিয়েছিলেন৷ ফলোআপ ভিজিটেও একই scenario ... মাত্র ৪-৫ জন রোগি৷ কৌতুহলবশত অন্যান্য ডাক্তারদের সিরিয়ালের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিলাম৷ অবাক হয়ে দেখলাম, প্রায় ৯০% রোগি দেখেন দুজন ম্যাডাম৷ আর ১০% রোগি দেখেন বাকি ১০-১১ জন৷ ডিগ্রী সবার সমান, সবাই ভালো ভালো হাসপাতালের সাথে যুক্ত৷ তারপরও রোগীদের এই অসম চাপের রহস্য মনকে কৌতূহলী করে তুললো৷ অন্য লেখায় এটার রহস্যভেদের গল্প বলবো (অবশ্যই তাদের দুজনের কেউই দালাল প্রাকটিস করতেন না)৷
॥ ২ ॥
২০১৩ সাল৷ আমি তখন ধানমন্ডির দি মেডিক্যাল সেন্টারে বসা শুরু করেছি৷ আমার পাশের চেম্বারেই বসতেন BSMMU এর Skin department এর একজন এসোসিয়েট প্রফেসর স্যার৷ আমি নতুন হলেও উনি ১৪ বছর ধরে ওখানে প্রাকটিস করতেন৷ কিন্তু স্যারের তেমন রোগী হতোনা৷ ১ থেকে ৩ এর মধ্যেই বেশিরভাগ দিন সীমাবদ্ধ থাকতো৷ আমি আমার এক রোগিকে একদিন স্যারের কাছে রেফার করলাম৷ রোগি স্যারকে দেখিয়ে আবার আমার চেম্বারে আসলেন৷ খুবই হতাশ এবং বিরক্ত৷ বললেন, কার কাছে পাঠালেন, কথা তো শুনলোই না, আবার ঠিকমতো দেখলোও না৷ খালি খালি আমার ৬০০/- নষ্ট করলেন৷ আমি বললাম, উনি অভিজ্ঞ ডাক্তার৷ দেখালেনই যখন, তখন স্যারের প্রেসক্রিপশন ফলো করে দেখেন৷ ঐ রোগি ফলোআপ ভিজিটে এলে তার skin এর সমস্যার কথা জিজ্ঞাসা করলাম৷ উনি হেসে বললেন, স্যারের চিকিৎসা খুব ভালো কাজ করেছে, আমি সম্পূর্ণ ঠিক হয়ে গেছি৷ এরপর স্যারের কাছে যতো রোগি রেফার করেছি, তাদের কেউই চেম্বার থেকে positive impression নিয়ে বের হয়নি ঠিকই, কিন্তু সবারই skin এর অসুখ সেরে গিয়েছিলো৷
॥ ৩ ॥
ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ডায়াবেটিস হাসপাতালের ডিরেক্টর৷ রোগি আসলে আধা ঘন্টার আগে ছাড়েন না৷ গল্প গুজব হাসি ঠাট্টায় রোগীকে মুগ্ধ করে ফেলেন৷ তার চেম্বার থেকে সব রোগীই হাসিমুখে বের হয়৷ অনেকে আবার বলে, অর্ধেক সুস্হ এখনি হয়ে গেছি৷ কিন্তু দুদিন পরই রোগীদের হাসি মিলিয়ে যায়৷ ডায়াবেটিস বেশি রয়েই যায়, অন্যান্য সমস্যারও কোন উন্নতি হয়না৷ একমাস পর আসার কথা থাকলেও, একসপ্তাহ পরেই রোগীকে আবার তার কাছে দৌঁড়ে আসতে হয়৷ অদ্ভুত দক্ষতায় তিনি রোগিকে বোঝান, রোগির দোষেই তার চিকিৎসা সফল হয়নি৷ রোগী কাচুমাচু হয়ে মুখ আসামীর মতো করে মেনে নেয় স্যারের কথা৷ অনেক রোগীকে আবার স্যার বুঝিয়ে শুনিয়ে ভর্তিও করে ফেলেন৷ Theme মোটামুটি এক - আপনার টা special case, হাসপাতালে মনিটর করে চিকিৎসা করতে হবে৷ হাসপাতালে রোগীকে ৮-১০ দিন ভর্তি রেখে উনি সুগার ১৬ থেকে ১০ এ আনেন৷
তারপরও তিনি একজন superstar ডাক্তার, অসংখ্য ভক্তের ভালোবাসায় সিক্ত৷
এই ঘটনা গুলি থেকে আমি বুঝেছিঃ
১) Imbalance কখনোই কোন structure কে গড়ে উঠতে দেয়না৷ কিছুদিন পর ঠিকই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে৷ আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়৷
যিনি নিজ মেধা, যোগ্যতা এবং বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে বিখ্যাত হয়েছেন, তিনি বিখ্যাত হবার পর, সেগুলোকে জলান্জলী দিয়ে দিলে মানুষের ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়না৷ Properly যেকজন রোগী আপনার পক্ষে দেখা সম্ভব, শুধু সে কজনকেই দেখুন৷ ভিজিট দরকার হলে তিনগুন করে দিন, তাতে আপনার daily income একই থাকবে৷ একটা ছোট্ট ১০ মিনিটের অপারেশন মানুষ ১০,০০০/- দিয়ে করাতে পারলে, সঠিক ডায়াগনোসিস এবং চিকিৎসার জন্য ৫,০০০/- টাকা ফি দিতে দ্বিধা করবেনা৷
আর এর সুদুরপ্রসারী সুফল? আপনার কাছ থেকে মানুষ জটিল সমস্যার সমাধান পাবে, আবার শিক্ষাগত যোগ্যতায় সমমানের অন্য ডাক্তারদেরও রোগী বাড়বে৷ এই balance টা যখন ঠিক হবে, কেবল তখনই মানুষ পোষ্ট গ্রাজুয়েট ডাক্তারদের ক্যারিশম্যাটিক সুফল ভোগ করতে পারবে৷ এখনকার মতো Post graduate GP service পেতে হবেনা৷
২) সময় বেশি দেয়া মানেই সবসময় ভালো চিকিৎসা দেয়া নয়৷ আবার সময় কম দেয়া মানেই খারাপ চিকিৎসা দেয়া না৷
৩) আমাদের সবারই জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে৷ সব সমস্যা বোঝা এবং চিকিৎসা করা কারো পক্ষেই সম্ভব না৷ তাই না বুঝে চিকিৎসা দিয়ে রোগীর ভোগান্তি এবং আর্থিক ক্ষতির কারণ না হয়ে, দ্রুত রেফার করে দেয়া উচিত৷ এতে ডাক্তারের প্রতি রোগীর আস্থা এবং শ্রদ্ধা দুটোই বাড়বে৷
৪) রোগিদের দৃষ্টিতে ভালো ডাক্তার তিনিই যিনি, চেম্বারের ভেতরেই রোগির ভরসা, ভালোবাসা এবং বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন এবং যার সুচিন্তিত সঠিক চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে৷ দুটোর একটিতেও ঘাটতি থাকলে, রোগীর মন জয় করা সম্ভব হয়না৷ চিকিৎসা শুধু শরীরের নয়,মনের ও হতে হয়। দুটির মধ্যে একটা ঠিক না থাকলে চিকিৎসা পরিপূর্ণ হয় না।