চিকিৎসকের জন্যেও মানবিকতার আলো জ্বালতে হবে
ডাক্তার এর পোস্টার
বাসে,ট্রাকে, ট্রেনের ছাদে, জাহাজে, স্টিমারে বহন ক্ষমতার বা সিটের অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া বেআইনি। কিন্তু সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন বহন ও সহনক্ষমতার ৪/৫ গুন বেশি রোগি থাকে। এটা অনিয়ম নয় কেন তা বুঝিনা।
দুদক, আদালত, সুশীল, সাংবাদিক, রাজনীতি ব্যবসায়ীমহল, পুলিশ, র্যাব, গণতন্ত্র রক্ষা বা উদ্ধারকারী বাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয় এর টকশোবিদ, সর্বকালের সর্ব বিষয়ের মহাজ্ঞানী সম্পাদক গণ, বামপন্থি, ডানপন্থি, গামছাপন্থি, চরমপন্থি কিংবা সদা শরমপন্থি চিকিৎসকগণ কেউই এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধাচরণ করেন না।
স্টিমার এ বহন ক্ষমতার ৪/৫গুন বেশি লোড দিয়ে পারাপার করলে তা নিমজ্জিত হবে এটা চোখে দেখা যায়। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা আইন শৃংখলা বাহিনী ও এমনটি হতে দিতে চান না। অথচ যুগের পর যুগ ধরে সরকারি হাসপাতাল সমূহ অকল্পনীয় বেশি রোগির চাপ, কাজের চাপ নিয়ে এখনও টিকে আছে বলে সবাই ধরে নিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে স্টিমার এর মতো অতিরিক্ত লোডে হাসপাতালও ডুবে যায়, কিন্তু তা সবার চোখে পড়ে না। মাথায় আসে না, জ্ঞানে কুলায় না। এই ডুবে যাওয়ার প্রকাশ অন্যরকম, লক্ষণ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
যে তিন মণের বোঁঝা নিতে সক্ষম তাকে বারো মণের বোঁঝা চাপিয়ে তার কাছে ১০০% সার্ভিস আশা করা বোকামি ছাড়া আর কি! অথচ সেটাই আশা করা হচ্ছে সরকারি চিকিৎসকদের কাছে।
এই মুহুর্তে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় ৪২০০ রোগি ভর্তি আছেন, অথচ এটা ১২০০ বিছানার ১২০০ জন রোগির চিকিৎসা ও সেবা প্রদানের ক্ষমতা রাখে। ৩ গুনেরও বেশি রোগি এরকম বছর জুড়েই থাকেন। বিশ্বাস করুন বা না করুন এই অতিরিক্ত রোগি দেখার জন্য বরাদ্দকৃত চিকিৎসকের অতিরিক্ত চিকিৎসক একজনও নাই, তা অকল্পনীয়। বরং ১২০০ বিছানার জন্য বরাদ্দকৃত প্রয়োজনীয় চিকিৎসকই এখানে নেই, কিছু কম আছে। নার্স সহ অন্যান্য জনবল আরো কম।
সেবার জন্য চিকিৎসকের চেয়ে নার্সের সংখ্যা নিয়মতান্ত্রিক ভাবেই বেশি থাকার কথা, কিন্তু তা চিকিৎসক এর চেয়েও কম। তাহলে হিসাব করুন ১২০০ জন রোগীর স্থলে ৪২০০জন রোগী কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্য সেবা পাবেন, মিষ্টি ব্যবহার পাবেন, যথাযথ সময়ে চিকিৎসকের দেখা পাবেন এইটা কিভাবে সম্ভব? ১২০০ রোগী ম্যানেজ করার জন্য এখানকার চিকিৎসকগণের ওপর যে পরিমাণ শারীরিক ও মানসিক ধকল যায় তার জন্য যে বিশ্রাম দরকার ৪২০০ রোগি ম্যানেজ করার পর নিশ্চই চিকিৎসকগনের আরো বেশি বিশ্রাম চাই। এইযে অতিরিক্ত মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রম তার মূল্যায়ন কিন্তু নাই।
বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক শুধুমাত্র দিনে কয়েকঘন্টা ছাত্র পড়িয়েই সম-র্যাংক বা মর্যাদার চিকিৎসক এর তুলনায় ২ গুন বেতন পান। আর চিকিৎসক তিন চার গুণ বেশি কাজ করে, নাইট ডিউটি করার পর আবার দিনে ছাত্র পড়ানোর পরও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ২গুন কম বেতন পান। অথচ তুলনামূলকভাবে চিকিৎসকই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চেয়ে বেশি মেধাবী। তাহলে মেধার অবমূল্যায়ন, অমানুসিক পরিশ্রম এর অবমূল্যায়ন হচ্ছে এটা প্রমানিত হলো। এখন এই অবমূল্যায়নের একটা প্রভাব থাকবে এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। সেই প্রভাব নানাভাবে পড়বে এটাই বাস্তব।
সব চিকিৎসকই মানুষ, তারা বছরের পর বছর এই সব অবমূল্যায়নসহ আরো নানাবিধ কারণে বদলে যেতে বাধ্য হন। প্রবল প্রতিকূল পরিবেশে কিছু মানুষ অনিয়মেও জড়িয়ে পড়েন। একজন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার,ইউ এন ও পদধারী, একজন চিকিৎসকের চেয়ে কম ( ব্যতিক্রম আছে কিছু) মেধার হওয়া স্বত্বেও সরকারি গাড়ী বাড়ী ক্ষমতাসহ নানাবিধ সুবিধা ভোগ করেন। এটার প্রভাব চিকিৎসক এর উপর পড়ে এটাই বাস্তব। চাপিয়ে দেয়া অনিয়ম, চরম অন্যায় ও জাতীয় মজ্জাগত অনিয়মের কবলে পড়ে কতিপয় চিকিৎসক ও অনিয়ম করে থাকেন, বা আসলে করতে বাধ্য হন।
এখন সেই অনিয়মের পেছনের কারণ উদঘাটনের সামান্যতম দৃশ্যমান চেষ্টা না করে, সকল চিকিৎসকের উপর জুলুম করাটা কি যৌক্তিক?
হাসপাতালেই দেশের সকল সমস্যা লুকিয়ে আছে, চিকিৎসক দাবড়িয়ে বেড়ালেই চরম উন্নয়ন হবে, মাদক, শেয়ার বাজার, ব্যাংকখাত, বেকারত্ব সহ সকল সমস্যার সমাধান হবে এমন নয়।
অন্ধকার দূর করতে হলে চিকিৎসকের জন্যেও মানবিকতার আলো জ্বালতে হবে আগে। নাহলে হাজারো সীমাবদ্ধতা নিয়েও চিকিৎসকরা যে সেবা দিচ্ছেন তা আরও ব্যাহত হবে।