বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন কেন?
সরকারি কর্ম কমিশন
সরকারি চাকরিতে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে অনেক আগে থেকেই। প্রশাসন পররাষ্ট্র ও পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বেশি। সমমানের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্যাডার ভিন্নতার কারণে কেউ বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবেন, তা হতে পারে না। এতে একদিকে যেমন ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈষম্যজনিত ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী, যারা চিকিৎসক ও প্রকৌশলী হয়ে থাকেন, তারা টেকনিক্যাল ক্যাডার বাদ দিয়ে জেনারেল ক্যাডারের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
সম্প্রতি কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে সুযোগ পাবার আধিক্য তার প্রমান বহন করে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশে মেধাবী চিকিৎসক ও প্রকৌশলীর সংকট দেখা দিবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের অবসান ঘটানো উচিত।
আমাদের দেশে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিম্নরূপঃ-
প্রশাসন ক্যাডারে শূন্য পদ না থাকা সত্ত্বেও পদের তিন-চার গুণ বেশি পদোন্নতির ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে বিশেষায়িত ক্যাডারের সদস্যদের পদোন্নতির সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। উল্লেখ্য, ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতের প্রশাসন সার্ভিসের জনবলের (৫ হাজার) তুলনায় আমাদের ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে প্রশাসন ক্যাডারে জনবল তার প্রায় দেড় গুণ।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য যেখানে স্পেশাল গ্রেড, অজস্র গ্রেড-১ ও গ্রেড-২-এর পদ রয়েছে, সেখানে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদদের অল্প কয়েকজন চাকরিজীবনের শেষ দিকে গ্রেড-২ বা গ্রেড-৩-এর পদে যেতে পারেন। বিশেষায়িত ক্যাডারে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ ব্যক্তিরই গ্রেড-৪ বা তার নিচ থেকে চাকরিজীবন শেষ করতে হয়। আগে পদোন্নতি না পেলেও আর্থিক সুবিধা প্রদানের জন্য সিলেকশন গ্রেডের ব্যবস্থা ছিল। সর্বশেষ বেতন স্কেলে সে ব্যবস্থাও রহিত করা হয়েছে।
বিভিন্ন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, করপোরেশনগুলোর পরিচালক ও তাঁর ওপরের পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন করা হয়। ফলে এসব দপ্তরের নিজস্ব কর্মকর্তারা পদোন্নতি পায় না।
উপসচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত সদস্যরা পাচ্ছেন ব্যক্তিগত ৩০ লাখ টাকার গাড়ি কেনার ঋণসুবিধা, রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মাসিক অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু অন্যরা এই সুবিধা পাচ্ছেন না।
পররাষ্ট্র ক্যাডারে যাঁরা নিয়োগ পান, তাঁরা বিদেশে পদায়নকালে বিদেশ ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, চিকিৎসার সব সুযোগ, সন্তানদের পড়াশোনার ভাতা ইত্যাদি পেয়ে থাকেন। সরকারি ব্যয়ে নিতে পারেন একজন গৃহপরিচারক। রাষ্ট্রদূতেরা সরকারি খরচে একজন বাবুর্চি ও একজন মালি নিয়োগ দিতে পারেন।
মাঠ প্রশাসনে কর্মরত থাকাকালে একজন ডিসি বা এসপি সহায়ক কর্মচারীর সুবিধা পান তাঁদের বাসভবনে। আছে ভালো গাড়ির সুবিধাও। তাঁদের জুনিয়র সহকর্মীরাও কর্মপরিধি বিবেচনায় ক্ষেত্রবিশেষে গাড়ির সুবিধা পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে পেশাজীবীদের যোগ্যতা ও দেশের উন্নয়নে তাঁদের অবদানের ভিত্তিতে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। জেলা/উপজেলার মাসিক সমন্বয় সভাসহ অন্যান্য সভায় কলেজের অধ্যক্ষ, কৃষি কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন, মৎস্য কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, নির্বাহী প্রকৌশলী ও অন্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য সম্মানজনকভাবে আসন সংরক্ষণ করা হয় না।
এ দেশে কোনো কোনো সার্ভিস ক্যাডারের সদস্যদের জনপ্রশাসন পদক, রাষ্ট্রপতি পদক প্রভৃতি প্রদানের মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বিশেষায়িত ক্যাডারের সদস্যদের মূল্যায়নের কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন চিকিৎসক এমবিবিএস, এফসিপিএস/এমডি পাস করে ২০-২৫ বছর উপজেলা পর্যায়ে চাকরি করেও সপ্তম গ্রেডের ওপরে উঠতে পারেন না বা ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পান না।
বিশেষায়িত ক্যাডারে নিয়োজিত জনবল যেন নিজ ক্ষেত্রেই মর্যাদা ও সন্তুষ্টির সঙ্গে কাজ করতে পারেন, সেদিকেও নজর দেওয়া জরুরি। সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ হিসেবে পদোন্নতি, গ্রেড-বৈষম্য, জনবল কাঠামো, বেতনবৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আন্ত-ক্যাডার বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন।
জনাব আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব তাঁর, ২৯শে মার্চ, ২০১৮ এর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রবন্ধ “আন্তক্যাডার বৈষম্য কীভাবে দূর হবে” তে আন্তক্যাডার বৈষম্যেগুলির সপক্ষে লিখেছেন, “একই বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সবাই চাকরিতে আসেন। এর মধ্যে প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশসহ সাধারণ ক্যাডারে যারা আসেন তাঁরা সুদীর্ঘ একটি তালিকা থেকে মেধা, প্রাধিকার কোটা ও পছন্দের ক্রম অনুসারে স্থান পান এসব পদে। তাহলে দেখা যায়, একই পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে এলেও প্রত্যেকের মেধাক্রম অভিন্ন নয়। আর অধিকতর মেধাবীরা তাঁদের পছন্দ অনুসারে আকর্ষণীয় চাকরিগুলো পাবেন, এটাই স্বাভাবিক। চাকরির সুযোগ-সুবিধা সাধারণত নির্ধারণ করা হয় তার কর্মপরিধি অনুসারে। এটা অনেক ক্ষেত্রেই অভিন্ন হবে না, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তেমনি পদোন্নতির সুবিধাদিও সে রকমই হওয়ার কথা। আর চাকরিতে সবাই এসেছেন নিজেদের মেধাক্রম, প্রাধিকার কোটা আর পছন্দের ভিত্তিতে।”
যেই সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব তাঁর মার্চ ২০১৮ এর একই লেখার শেষ দিকে, “যাঁরা এ ব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন, তাঁদের জন্য এসব চাকরির দ্বার রুদ্ধ ছিল না”, বলে বড়াই করেছিলেন, তিনিই তাঁর ০৫/০৭/২০২০ তারিখে প্রথম আলোতে লেখার শিরোনাম “সাধারণ ক্যাডারে এত বিশেষায়িত ডিগ্রিধারী কেন”? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। এত জোরালো ভাবে শিরোনামেই প্রশ্ন ছুঁড়েছেন যে মনে হচ্ছে “সাধারণ ক্যাডার” উনার উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি, পূর্বপুরুষদের কেউ সাফ কবলা করে রেখে গেছেন।
জনাব আলী ইমাম মজুমদার সাহেবের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, খুব তো বড়াই করে বলেছিলেন,
“সাধারণ ক্যাডারে যারা আসেন তাঁরা সুদীর্ঘ একটি তালিকা থেকে মেধা, প্রাধিকার কোটা ও পছন্দের ক্রম অনুসারে” এবং “যাঁরা এ ব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন, তাঁদের জন্য এসব চাকরির দ্বার রুদ্ধ ছিল না”।
?????? কোথায় গেল আপনার সেই দম্ভোক্তি?? বিশেষায়িত ক্যাডার কি মেধার শক্তিতে আপনার সেই দর্প চূর্ণ করে দেয়নি??? “সাধারণ ক্যাডারে এত বিশেষায়িত ডিগ্রিধারী কেন?” বলে কিসের, কাদের,এবং কেন এতবড় হুংকার???
মেধার বড়াই তো অনেক হলো, আসুন আমরা মেধা নিয়েই খেলি। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদেই তো ছিলেন, অনেক ক্ষমতাবান ছিলেন, মানষিক দৈন্যতার কারনে মেধাবী পেশাজীবিদের উন্নয়নে কিছু করেছিলেন কি?? আসলে মেধার সঠিক মুল্যায়নের জন্য মন,মানষিকতা, সততা, দৃঢ়তা ও মেধা যা থাকা প্রয়োজন, এর কোনটাই আপনার ছিলনা, এখনও নেই।
যদি বলেন, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের জন্য বিশেষায়িত ক্যাডার আছে! তাইলে তাদের মন্ত্রলায়কে “কলার গুদাম” বানিয়েছেন কেন? ক্যাডার বৈষম্য দূর করে তাদের মন্ত্রনালয় তাদের হাতে দিয়ে দিলে তারা আর সাধারন ক্যাডারে যাবে না। সাধারণ মানে তো শুধু কলা নয়।
‘সাধারণ ক্যাডারে’ মোট চৌদ্দটা ক্যাডার আছে তার মধ্য যে সব ক্যাডারের নামে বিশ্ব বিদ্যালয়ে কোর্স কারিকুলাম আছে, যেমন জন প্রশাসন নিয়ে পড়াশোনা করে জনপ্রশাসন ক্যাডার, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পররাষ্ট্র কাডার, একাউন্টিং নিয়ে নীরিক্ষা ও হিসাব ক্যাডার, অর্থনীতি নিয়ে ইকোনোমিক ক্যাডার ইত্যাদি বিশেষায়িত ক্যাডার করে নিলে সাধারণ ক্যাডারের সংখ্যা ও চাপ কমে যাবে। সব কলাদের নিয়ে সর্বকাজের ‘কাজীকলার প্রশাসন, এই প্রতিযোগিতামূলক আধুনিক বিশ্বে প্রয়োজন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যক্রমে কর্মমুখি বিষয় সমূহ অন্তর্ভূক্ত করলেই সাধারন নামক ক্যাডারগুচ্ছ একসময় লোপ পাবে।
জনাব আলী ইমাম মজুমদার সাহেবকে সবিনয়ে অনুরোধ করছি, আপনার নুন্যতম জ্ঞান বুদ্ধি ও প্রজ্ঞাকে জীবনের এর গোধূলিলগ্নে সৎভাবে কাজে লাগান। ক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিন, যাতে প্রত্যেক ক্যাডারের লোকজন প্রাপ্ত সকল সুযোগসুবিধা ভোগ করে সন্তুষ্টি ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করতে পারে। কিন্তু আপনি এ কি করছেন? জীবন সায়াহ্নে এসেও আপনি বিশেষায়িত ডিগ্রীধারীদের সাধারণ ক্যাডারে প্রবেশ বন্ধ করার লক্ষ্যে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ও সিলেবাসের আমূল পরিবর্তনের কুমন্ত্রনা দিচ্ছেন।পিএসসিকে এমন পরামর্শ দেবার আপনি কে? বাংলাদেশ এর বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রে আপনার অবস্থান কি ও কোথায় ? কোন যুক্তিতে পরামর্শ দিয়েছেন, বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় মোট ৯০০ নম্বরের মধ্যে যে মাত্র ১০০ নম্বর বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছিল, তা বাদ দিতে?? আপনার এই পরামর্শ বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯। (১) অনুচ্ছেদের (“প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।”) পরিপন্থী নয় কি?? আপনার মতো একজন প্রাক্তন জাঁদরেল আমলা ও নব্য বুদ্ধিজীবির উর্বর মস্তিস্কপ্রসুত প্রস্তাব যদি এমন হয় তা সত্যিই দুঃখজনক।এ প্রজন্মের চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা তাদের মেধা দিয়েই এর যথাযথ জবাব দেবে। তবে বাংলাদেশ সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, বিজ্ঞানে সম্পূর্ন অজ্ঞ মাথাভারী জনপ্রশাসন দিয়ে তাদের স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে কি? পরীক্ষায় বিজ্ঞান বাদ দিয়ে কলাদের শেষ রক্ষা হবে কি? এমন করা হলে বিশেষায়িত ডিগ্রীধারী মেধাবীরা অপমানের প্রতিশোধ নিতে সাধারণ ক্যাডার প্রবেশের জন্য চ্যালেঞ্জ নিয়েই নামবে। আমরাও আমাদের উত্তরসূরিদের সাধারণ ক্যাডার প্রবেশে উৎসাহিত করবো। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ৫০% সাধারণ ক্যাডারপদ বিশেষায়িত ডিগ্রীধারীদের দখলে আসবে ইন-শা-আল্লাহ (যদি নিয়মিত বিসিএস পরীক্ষা হয়)