নতুন বিসিএস চিকিৎসকদের যা জানা জরুরি

ডা. মো. জয়নাল আবেদীন টিটো
2022-02-27 15:04:04
নতুন বিসিএস চিকিৎসকদের যা জানা জরুরি

আপনি বা আপনার পিতা-মাতা অসুস্থ হলে যে আচরণ আপনি আশা করতেন, রোগীর সাথে সে আচরণ আপনার নৈতিক দায়িত্ব

প্রথম কর্মস্থলে যোগদান করতে যাচ্ছেন ৪২তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকরা। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আপনার প্রথম যোগদান বর্ণাঢ্য এবং স্মৃতিময় হোক, এ কামনা করছি। জীবনের অনন্য আনন্দময় দিনে আমার কিছু কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে হচ্ছে।

১. যে উপজেলায় আপনার পদায়ন হয়েছে, আপনি সে উপজেলার ইউএইচএফপিও’র ফোন নম্বর সংগ্রহ করুন। তাকে ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলুন। উপজেলায় তিনিই আপনার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা। আপনার উচিত হবে ইউএইচএফপিও’র উপস্থিতিতে তার কক্ষে বসে যোগদানপত্র দাখিল করা। আগে থেকে কোনো যোগাযোগ না করে ইউএইচএফপিও’র অনুপস্থিতিতে যোগদান করা অসুন্দর দেখায়।

২. আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় কর্মস্থলে যোগদানের আদেশ দেওয়া হয়েছে। ওইদিনই যোগদান করবেন, এর ব্যত্যয় করা ঠিক হবে না। যোগদানের দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাকে যাবেন। ছেলেরা স্যুট-টাই, দাঁড়ি থাকলে পরিপাটি আর না রাখলে ভালোভাবে শেভ করে যাবেন।

৩. উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছে সবার আগে ইউএইচএফপিও’র কক্ষে গিয়ে আপনার যোগদান করার ইচ্ছে তাকে জানান।

৪. আপনি যোগদানপত্র দাখিল করবেন ‘উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা’ বরাবর। এবার যোগদানপত্রের সাথে নিম্নলিখিত কাগজগুলো কমপক্ষে ৫ কপি করে লাগবে। অর্থাৎ কমপক্ষে ৫ সেট যোগদানপত্র সাজাবেন। এতে থাকবে—

ক. ইউএইচএফপিও বরাবর যোগদানপত্র।

খ. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়োগাদেশের (নিয়োগের গেজেট হিসেবে পরিচিত) ফটোকপি। এই প্রজ্ঞাপনের প্রথম পৃষ্ঠা, যে পৃষ্ঠায় আপনার নাম আছে, সে পৃষ্ঠা এবং শেষ পৃষ্ঠা— কমপক্ষে এই তিনটি পৃষ্ঠা থাকা উচিত। প্রথম পৃষ্ঠায় নিয়োগদানকারী মন্ত্রণালয়ের নাম এবং স্মারক নম্বর থাকে। শেষ পৃষ্ঠায় স্মারক নম্বর থাকে এবং সরকারের পক্ষে যিনি প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন, তার নাম, পদবি এবং স্বাক্ষর থাকে। বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট প্রেস থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটে শুধু নাম থাকে, স্বাক্ষর থাকে না।

গ. আপনার পদায়নের আদেশ, যে আদেশে আপনাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কেন্দ্রে পদায়ন করা হয়েছে। পদায়নের আদেশের প্রথম পৃষ্ঠা, যে পৃষ্ঠায় আপনার নাম লেখা আছে, সে পৃষ্ঠা এবং শেষ পৃষ্ঠা— কমপক্ষে এই তিনটি পৃষ্ঠা।

ঘ. আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র, যা আপনার জাতীয় পরিচয় জ্ঞাপন করবে।

ঙ. আপনার এসএসসি সনদ, বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস অনুযায়ী এটি আপনার বয়সের প্রমাণপত্র।

চ. আপনার এমবিবিএস উত্তীর্ণের সনদ, যে কারণে আপনি মূল বেতনের সাথে একটি ইনক্রিমেন্ট বেশি পাবেন।

ছ. আপনার ইন্টার্নশিপ ট্রেনিংয়ের সনদ।

জ. আপনার বিএমডিসি নিবন্ধন সনদ, যার কারণে আপনি মূল বেতনের সাথে আরও একটি ইনক্রিমেন্ট বেশি পাবেন।

ঝ. আপনি এবং আপনার পরিবারের সদস্যরা কখনো কোনো দিন যৌতুক নিবেন না বা দিবেন না— এ মর্মে ৩০০ টাকার রেভেনিও স্ট্যাম্পে লিপিবদ্ধ অঙ্গীকারনামা।

ঞ. যোগদানের সময় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে হয়। আপনাদের জন্য বিবরণী দাখিলের তারিখ সামান্য শিথিল করা হয়েছে। এটি যোগদানের সময় জমা না দিয়ে ৩১ মার্চের মধ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠালেই চলবে। [সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ১৩ নম্বর ধারা মোতাবেক সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে হবে] এ বিবরণীতে উল্লেখ করতে হয়— যে জেলায় সম্পত্তি, সে জেলায় নাম, পৃথকভাবে অলংকারের হিসাব।

প্রশ্ন হতে পারে, যোগদানপত্র ৫ সেট লাগবে কেন? উত্তর— প্রথম সেট আপনার অফিসে, আপনার নামে খোলা ফাইলে সংরক্ষিত থাকবে। দ্বিতীয় সেট চলে যাবে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাকিগুলো বিভাগীয় পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও উপজেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে চলে যাবে।

যোগদানপত্র যেমন হতে পারে
আমি একটি নমুনা দেই। তবে এর চেয়ে ভিন্নভাবে যোগদানপত্র তৈরি করার স্বাধীনতা আপনার রয়েছে।

বরাবর
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
করিমগঞ্জ, জেলা- কিশোরগঞ্জ
বিষয়: যোগদানপত্র অথবা সহকারী সার্জন পদে যোগদানপত্র

জনাব/মহাত্মন
যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক নিবেদন এই যে, আমি ডা. মো. ইবনে আদম (কোড নম্বর ১৪৪৪৪৪, ইচ্ছে করলে এর সাথে এনআইডি নম্বরও দিতে পারেন) ৪২তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নবনিয়োগ শাখা থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ খ্রি. ইস্যুকৃত প্রজ্ঞাপন নম্বর ০৫.০০.০০০০.১৪৭.১১.০১১.২১-৪৩ মূলে আমাকে সহকারী সার্জন পদে নিয়োগ করা হইয়াছে এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ খ্রি. জারিকৃত প্রজ্ঞাপন নম্বর ৪৫.০০.০০০০.১৪৮.১১.০২০.২০২১—১৬৩ মূলে আমাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পদয়ায়নপূর্বক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, করিমগঞ্জ, জেলা কিশোরগঞ্জে সংযুক্ত করা হইয়াছে। সেই মোতাবেক আমি অদ্য ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ খ্রি. সোমবার সকাল ৯ ঘটিকায় অত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সহকারী সার্জন পদে যোগদানপত্র দাখিল করিলাম।

অনুগ্রহপূর্বক আমার যোগদানপত্র গ্রহণ করিয়া বাধিত করিবেন।

বিনীত নিবেদক

ডা. মো. ইবনে আদম
কোড নম্বর ১৪৪৪৪৪
এনআইডি নম্বর ১২৩৪৫৬৭৮৯
সহকারী সার্জন
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, করিমগঞ্জ
উপজেলা করিমগঞ্জ, জেলা কিশোরগঞ্জ।

কাগজপত্র আগে সত্যায়ন লাগে কি
এখন প্রশ্ন হলো, কাগজপত্র সত্যায়ন করে নিতে হবে কি কিনা? আপনি সব ডকুমেন্টের মূল কপি সাথে করে নিয়ে যাবেন। ইউএইচএফপিও চাইলে সত্যায়িত করবেন। আমি যখন ইউএইচএফপিও ছিলাম, তখন যোগদান করতে আসা চিকিৎসকদের তাদের কাগজপত্র সত্যায়ন করে আনতে বলিনি। আমি নিজে মূল সার্টিফিকেটের সাথে মিলিয়ে দেখতাম এবং নিজে ভ্যারিফাইড লিখে সাইন করে সিল মারতাম। ইউএইচএফপিও আপনার যোগদানপত্রে স্বাক্ষর করার পর আপনার যোগদান পর্ব শেষ হবে।

এরপর আপনার করণীয় বিষয়ে ইউএইচএফপিও’র কাছ থেকে ব্রিফিং নিন। তিনি আপনার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা। সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্য, উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচালনা করার জন্য এবং সবার কাছ থেকে কাজ আদায় করার জন্য তিনিই সরকারের প্রতিনিধি।

আরও যা না জানলেই নয়
> আপনি আপনার কর্মস্থলে অবস্থান করুন। জেলা সদর থেকে যাতায়াত করলে সড়ক দুর্ঘটনায় আপনার পরলোক গমন করার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং কর্মস্থলে অবস্থান করাই নিরাপদ।

> আপনার জন্য খাট-পালংক, চেয়ার-টেবিল আলমারি— কোনো কিছুই বরাদ্দ নেই। যোগদানের পর ভালো মানের খাট, পড়ার জন্য চেয়ার, টেবিল নিজের ব্যক্তিগত ব্যবহারের আলমারি নিজের টাকায় কিনে নিন। মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ যে মানের আসবাবপত্র ব্যবহার করে, আপনি সেই মানের আসবাবপত্র ক্রয় করুন।

> কয়েকজন মিলে পড়াশোনার গ্রুপ তৈরি করে নিন। সময় ভালো কাটবে।

সঠিক সময়ে কর্মস্থলে হাজির হবেন। আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করবেন। নির্ধারিত সময়ের আগে কর্মস্থল ত্যাগ করবেন না।

> রোগীদের সাথে উত্তম আচরণ করবেন। আপনি বা আপনার পিতা-মাতা অসুস্থ হলে যে আচরণ আপনি আশা করতেন, সে ধরনের আচরণ করবেন। এটি আপনার নৈতিক দায়িত্ব।

> যারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের ছোট মনে করবেন না। তারা বিনাপয়সায় চিকিৎসা নেন না। জনগণের পক্ষ থেকে সরকার তার নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতন পরিশোধ করে।

> ডায়াগনস্টিক সেন্টার যতই হাতছানি দিক, কখনোই অফিস সময়ের বাইরে গিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা অন্য কোনো কাজ করবেন না। এটি অন্যায়। নিশ্চিত থাকুন, অন্যায় করে বিপদে পড়লে আপনার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসবে না।

> সহকর্মী চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য সব কর্মচারীদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখবেন। কারও সাথে বিবাদে জড়ালে তা নিজের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।

> অন্যান্য অফিসের এবং স্থানীয় জনগণের সাথে উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখলে তা আপনার সম্মান ও শক্তি— উভয় বৃদ্ধি করবে।

> ওষুধ কোম্পানির সাথে বা স্থানীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে বেশি জড়াবেন না। এতে আপনার মর্যাদাহানী হবে।

লেখক: ডা. মো. জয়নাল আবেদীন টিটো
বিভাগীয় প্রধান, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান


আরও দেখুন: