ঢাকা মেডিকেল থেকে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে অক্সফোর্ডে স্বপ্নযাত্রা
ডা. শিহাব উদ্দীন আল-আবিদ
বছর কয়েক আগের কথা, ইন্টার্নশিপ চলছিল আমার। ঢাকা মেডিকেল প্রাঙ্গনে প্রায় ছয় বছর কাটানোর পরও কোন বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়বো তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। ব্যাপারটা আমার নিজের জন্য কিছুটা চিন্তার উদ্রেককারীই ছিল। বরাবরই ‘ভার্সিটি লাইফ’ শব্দটা আমায় খুব টানতো। কিন্তু ক্যাডেট কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সরাসরি মেডিকেল কলেজে এসে পড়ায় প্রায় এক যুগ ধরে বয়ে বেড়ানো ‘কলেজ স্টুডেন্ট’ তকমাটা তখনো ঝেড়ে ফেলতে পারিনি।
অনাস্বাদিত এই ‘ভার্সিটি লাইফ’ এর লোভেই বোধহয় বাইরের কোনো খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তখন ভাবতেও পারিনি, মেডিকেল জীবনের সবচেয়ে ভীতিকর বিষয়টিকে ঘিরেই শুরু হবে আমার সামনের পথচলা।
ইন্টার্নশিপের মাঝে সপ্তাহ দুয়েকের একটা ছুটি পাওয়ায় ভাবলাম সময়টা কাজে লাগাই। ‘গবেষনা’ নিয়ে আগ্রহ ছিল কিছুটা, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের রিসার্চ সেন্টার বলতে সবাই ICDDR,B কেই বুঝতো। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, এপিডেমিওলজি ও বায়োস্ট্যাটিস্টিক্সের ওপরে দুই সপ্তাহেরই একটা কোর্স শুরু হবে সেখানে।
কিছুটা ঝোঁকের বশেই শেষ করলাম কোর্সটা। ICDDR,B তে কে-৩৯ ব্যাচের ডা. মনিরুল ইসলাম স্যারের অধীনে এই কোর্সের সপ্তাহ দুয়েক সময়টাই আমার ক্যারিয়ার সিলেকশনের টালমাটাল পরিস্থিতিতে কিছুটা স্থিতি এনে দিলো। সিদ্ধান্ত নিলাম, এপিডেমিওলজিতেই ক্যারিয়ার করবার। রোগীর চিকিৎসা করার আগেই যদি রোগের গতিপ্রকৃতি পাল্টে দেওয়া যায়, একজন চিকিৎসক হিসেবে এর চাইতে চমকপ্রদ ক্যারিয়ার আর কী হতে পারে! যদিও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রচলিত চিকিৎসকের প্রতিচ্ছবি থেকে নিজেকে বের করে জনসাধারণের কাছে তুলনামূলক কম পরিচিত পথ গবেষণার পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু বেশ কাঠ-খড় পুড়িয়েই সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম আমি।
ইন্টার্নশিপের পরপরই কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই IEDCR এ বাংলাদেশে এপিডেমিওলজিস্টের জন্য স্বপ্নের একটি ট্রেনিং প্রোগ্রাম - CAPABLE (Cambridge Program to assist Bangladesh in Lifestyle and Environmental Risk Reduction) এ অংশ নেওয়ার জন্য নির্বাচিত হলাম আমি। ট্রেনিং প্রোগ্রামটি পরিচালিত হয়েছিল ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় সহ সাতটি প্রতিষ্ঠানের সামষ্টিক তত্ত্বাবধানে ও যুক্তরাজ্য সরকারের অর্থায়নে।
ব্যতিক্রম ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যে ভুল হয়নি, তখন আরও ভালোভাবে বুঝেছিলাম। ট্রেনিং চলাকালীনই আমি জীবনের প্রথম প্রফেশনাল চাকরি হিসেবে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের অন্যতম আঁতুড়ঘর ICCDRB তে যোগদান করার সুযোগ পাই। এরপর যোগদান করি National Heart Foundation and Research Institute এ বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ গবেষনা প্রকল্প ‘বিলিভ স্টাডি’ তে। এই প্রকল্পে বাংলাদেশের ৭৫,০০০ মানুষের তথ্য ও বায়োলজিকাল নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে যা অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে আমার মেন্টর ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত কার্ডিওভাস্কুলার এপিডেমিওলজিস্ট কে-৩৯ ব্যাচের প্রফেসর ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী স্যার।
কর্মজীবনে ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ফাঁকে ফাঁকে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের টুকটাক কাজও এগিয়ে রাখছিলাম। স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ হিসেবেই বোধহয় ২০২০ এর জুলাইয়ের শেষে হঠাৎ একটা মেইল পেলাম Netherlands Institute for Health Science( NIHES) থেকে, জানতে পারলাম NIHES এর ‘ Fellowship for Erasmus Summer Program -2020’ এর জন্য নির্বাচিত হয়েছি আমি। তিন সপ্তাহ যদিও নেদারল্যান্ডসেই থাকার কথা ছিল আমাদের, কিন্তু কোভিড পরিস্থিতির জন্য অনলাইনেই সম্পন্ন হলো সকল কর্মসূচি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা অধরাই রয়ে গেলো তাই!
অবশেষে ২০২১ এর ফেব্রুয়ারিতে এসে বহুদিনের সেই স্বপ্ন পূরণ হল আমার। প্রতিদিনের মতোই অভ্যাসবশত মেইল চেক করতে গিয়ে একটা মেইল দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমি। University of Oxford থেকে এসেছে মেইলটা, আমার জন্য নিয়ে এসেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘Global Health Science and Epidemiology’ তে স্নাতকোত্তর করার অফার লেটার, যেটি কিনা উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক বিষয়ের একটি। অক্টোবরে শুরু হবে সেই মাস্টার্স প্রোগ্রাম। শুরু হলো ছয় মাসের অপেক্ষা।
কিন্তু এই ছয় মাসে যে আমার জন্য আরও কত চমক অপেক্ষা করছে তা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি। জুন এবং জুলাই মাসে আমি পরপর অতি মর্যাদাপূর্ণ দুইটি ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপের জন্য নির্বাচিত হই। প্রথমটি ইউকে গভর্নমেন্ট প্রদত্ত Chevening Awards (FCDO), আর দ্বিতীয়টি বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত PM fellowship। যেহেতু একইসঙ্গে দুইটি স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স করতে আসার কোন উপায় নেই, তাই একজন Chevening scholar হয়েই পা রাখি স্বপ্নের ক্যাম্পাস অক্সফোর্ডে।
বছরকয়েক আগে যেই স্বপ্ন চোখে কিছুটা ভয়ে ভয়েই ভিন্ন এক পথে পা বাড়িয়েছিলাম আমি, যেই স্বপ্ন পূরণের অংশ হিসেবে আজ দিন কাটছে কর্মব্যস্ত অক্সফোর্ডে, তার শুরুটা কিন্তু হয়েছিল মিলন চত্বর- ঘাস চত্বরময় প্রাণের সেই ডিএমসি ক্যাম্পাসেই।
ডিএমসিতে পড়ার সুবাদে এমন অসাধারণ কিছু শিক্ষক পেয়েছি, প্রাণোচ্ছল ও প্রত্যয়ী এমন কিছু ক্লাসমেট-সিনিয়র-জুনিয়রের সঙ্গে পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়েছে, যারা এখনো আমার অনুপ্রেরণার উৎস। পথচলা মাত্র শুরু, পাড়ি দিতে হবে আরও অনেকটা পথ। স্বপ্ন দেখি, এপিডেমিওলজির আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থানের।
তরুণ চিকিৎসকদের তাই আহ্বান জানাই স্রোতের বিপরীতে চলার সাহস দেখাতে। রোগতত্ত্বের এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে সবাই মিলে প্রিয় বাংলাদেশের জন্য যখন কিছু করতে পারবো, পৃথিবীকে কিছু উপহার দিতে পারবো, তখনই সার্থক হবে আমার এই পথচলা।
ডা. শিহাব উদ্দীন আল-আবিদ
এমএসসি শিক্ষার্থী
গ্লোবাল হেলথ সাইন্স এন্ড এপিডেমিওলজি
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
কার্টেসি: হিউম্যানস অব ডিএমসি