ডায়াবেটিস সেবা নিতে আর দেরি নয়

অধ্যাপক মো. ফারুক পাঠান
2021-11-16 20:03:38
ডায়াবেটিস সেবা নিতে আর দেরি নয়

আইডিএফ-এর মতে বর্তমানে বাংলাদেশ ৮০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

ডায়াবেটিস বা বহুমূল বিপাকক্রিয়ার রোগ। যেখানে সার্বক্ষণিকভাবে রক্তের শর্করা বেশি পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বে এই রোগটি নতুন নয়। চার হাজার বছর আগে মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস থেকে এই রোগের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। ১৯২১ সালে ইনসুলিন আবিষ্কারের আগে এই রোগ হওয়া মানেই ছিল অবধারিত মৃত্যু।

ইনসুলিন আবিষ্কার ও ইনসুলিনের সঙ্গে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্পর্ক প্রমাণ হওয়ায় চিকিৎসা হিসেবে ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিনের প্রয়োগ শুরু হয়। মানুষ বাঁচার ও আশার আলো দেখতে পায়। কিন্তু মৃত্যুর হার ও ঝুঁকি থেকে এখনো আমরা মানুষকে মুক্ত রাখতে পারিনি। অন্য সাধারণ মানুষের মতো আয়ুষ্কাল ও জটিলতামুক্ত জীবন সবারই কাম্য।

ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) ২০১৭ সালে সারাবিশ্বে ৪২ কোটি লোক এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ২০৪৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৭০ কোটিতে। আইডিএফ-এর মতে বর্তমানে বাংলাদেশ ৮০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ধারণা করা হয়, ২০৪৫ কিন্তু ২০৪৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১ কোটি ৫০ লাখে। বর্তমানে আইডিএফ-এর সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশের শতকরা ৭-৮ ভাগ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ।

গত ২০১৮ সালে ১৪ নভেম্বরকে উপলক্ষ করে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি আয়োজিত ১ লাখ মানুষের (যারা জানেন না ডায়াবেটিস আছে কিনা) ওপর ডায়াবেটিস ক্রিনিং টেস্ট করা হয়। সেখানে ২৫ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে বাস্তবে বাংলাদেশের চিত্র অনেক ভয়াবহ। জন্মগত, বংশগত কারণ যাই থাকুক না কেন অতি দ্রুততার সাথে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ফলে জীবন যাত্রার পরিবর্তন এই ভয়াবহতার অন্যতম কারণ বলে ধারণা করা হয়।

যে হারে দ্রুততার সাথে এই রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে পরিবার, সমাজ ও দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে। বেশির ভাগ প্রভাব পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের দেশগুলাতে। এসব দেশে প্রতি ৪ জনের ৩ জনই ডায়াবেটিস আক্রান্ত। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসের যে কয়টি ধরন আছে তার অধিকাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তার মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ ব্যক্তিই জানেই না যে তাদের ডায়াবেটিস আছে। বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ থাকে না। এমন ধরনের ডায়াবেটিক রোগীদের সংখ্যাই বেশি। ফলে রোগ নির্ণয় হয় না এবং চিকিৎসা বিলম্বিত হয়। ফলে দীর্ঘদিন চিকিৎসার বাইরে থাকায় তারা ডায়াবেটিসজনিত নানা জটিলতা নিয়ে প্রথমবারের মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়।

সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে ডায়াবেটিক রোগীদের অন্যদের তুলনায় কিডনির রোগে, চোখের দৃষ্টিশক্তিহীনতা, স্নায়ু সমস্যা, হার্টের জটিলতা, স্ট্রোক, পায়ের পচন ও পঙ্গুত্ব অনেকগুণ বেশি হচ্ছে। কিডনিজনিত কারণে ডায়ালাইসিস, কিডনি ট্রান্সপ্লানটেশন, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও দৃষ্টিশক্তিহীনতা ইত্যাদির মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর এর ফলে চিকিৎসা ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর ও চাপ বাড়ছে। অপরিণত বয়সে ডায়াবেটিসজনিত মৃত্যুর হার অনেকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার ব্যয় অনেকগুণ বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাপ পড়েছে। দিন দিন এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

সুখবর হলো- জনগণ এবং চিকিৎসকের মধ্যে যদি সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, দ্রুত রোগ নির্ণয় করা যায় ও সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করা যায়, তবে একজন ডায়াবেটিস রোগী সারা জীবন জটিলতামুক্ত জীবন অতিবাহিত করতে পারে। নিজের জীবনকে আরও অনেক উন্নত করে দেশ ও দশের উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে। তাই আর দেরি নয় আসুন, আজই আমরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হই যে আমাদের ডায়াবেটিস আছে কি নেই।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যাদের বেশি- যারা স্থুল বা অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী, বয়স ৩৫ বা তার বেশি, ডায়াবেটিসের পরিবারিক ইতিহাস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি, হৃদরোগ, কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি। স্টেরয়েড বা মানসিক রোগের ওষুধ খাচ্ছেন, বিষন্নতায় ভুগছেন, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস আছে, দ্রুত নিকটস্থ ডায়াবেটিস সেন্টারে তাদের যাওয়া উচিত। দেখা উচিত আপনার ডায়াবেটিস আছে কিনা। যাদের এখনও ডায়াবেটিস হয়নি, তারাও ভবিষ্যতে কীভাবে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায় সেই বিষয়ে পরামর্শ নিন।

এখানে উল্লেখযোগ্যভাবে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে যে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ৬০-৭০ ভাগ প্রতিরোধযোগ্য। নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম, সুষম খাদ্য গ্রহণ ও স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখা, মানসিকভাবে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা এই রোগ প্রতিরোধ করতে যথেষ্ট। নিজেকে রক্ষা করুন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করুন সুশৃঙ্খল ও সুস্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের পন্থা অবলম্বন করার জন্য। তাহলেই আমরা পারবো ভবিষ্যত প্রজন্মকে এই রোগ ও তার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে।

শুধু জীবনযাত্রার পরিবর্তন নয় বরং এর পাশাপাশি শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য রোগীর ওষুধ ও ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়। যেহেতু এ রোগের প্রকোপ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বেশি, তাই প্রতি ২ জনের ১ জন ডায়াবেটিস রোগীর ওষুধ কেনার সামর্থ্য থাকে না।

যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা আছে প্রি-ডায়াবেটিক অথবা যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা আর দেরি না করে দ্রুত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত বিভিন্ন জেলা, উপজেলা পর্যায়ে যে সকল ডায়াবেটিস স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র আছে, সেখানে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ডায়াবেটিস সেবা নিতে আর দেরি নয়, ইনসুলিনসহ ডায়াবেটিসের অন্যান্য সেবা নেয়ার সুযোগ নিন এখনই।

এখানে উল্লেখ্য, এসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্রয়োজনে আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা, ডায়াবেটিস শিক্ষা, ওষুধ, ইনসুলিন সরবরাহ করে থাকে। এই সুযোগ নিয়ে দ্রুত রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন, সুস্থ জীবন যাপন করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ কমান। একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান অর্থনীতিতে অবদান রাখুন।


আরও দেখুন: