টিকার বুস্টার ডোজ নিয়ে যা জানা জরুরি
করোনার টিকা দেওয়ার প্রথম ছয় মাস কার্যকারিতা থাকলেও এক বছর পর এটির কার্যকারিতা নিশ্চিত করা যাবে না
করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করা। কিন্তু বিশ্বে টিকা স্বল্পতার কারণে নতুন নতুন করোনার ধরন আসছে। ফলে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, দুই ডোজের পর আরেকটি টিকা বা বুস্টার ডোজের প্রয়োজন আছে কিনা?
এ প্রশ্নের সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীরা করোনা পরিস্থিতি নিবীড়ভাবে পর্যালোচনা করছেন। বুস্টার ডোজ নিয়ে সবারই বর্তমান পরিস্থিতি জানা দরকার। মডার্না ও ফাইজার কয়েক মাস ধরে এমআরএনএ টিকার তৃতীয় ডোজের অনুমোদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ (এফডিএ) প্রশাসনে বিভিন্ন গবেষণামূলক তথ্য উপস্থাপন করছে। তারা বড় ধরনের গবেষণার ফলাফলও প্রকাশ করেছে।
মডার্নার গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যারা টিকা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার একই বছরের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে টিকাগ্রহণকারীদের তুলনায় ৩৬ ভাগ বেশি। অর্থাৎ, ছয় মাস আগে টিকা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার বেশি। এ থেকে তারা আশঙ্কা করছেন, ওই ছয় মাসে তাদের অ্যান্টিবডির পরিমাণ কিছুটা হলেও কমেছে।
একইভাবে ফাইজার গত ২৮ জুলাই একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, ফাইজারের টিকার দুটি ডোজ দেয়ার ছয় মাস পর করোনা প্রতিরোধে টিকার কার্যকারিতা ৮ ভাগ কমে যায়। ইসরায়েল ও ইংল্যান্ডের পৃথক গবেষণায় সময়ের সাথে সাথে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের টিকার কার্যকারিতা কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মডার্না ও ফাইজারের বিজ্ঞানীদের যুক্তি, করোনার টিকা দেওয়ার প্রথম ছয় মাস কার্যকারিতা থাকলেও এক বছর পর এটির কার্যকারিতা নিশ্চিত করা যাবে না। এছাড়া প্রতিনিয়ত করোনার নতুন ধরনের আবির্ভাব হওয়ায় কার্যকারিতা আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এখানে বলে রাখা দরকার, উপরোক্ত গবেষণার কার্যকারিতা কমে যাওয়া বলতে টিকা গ্রহণকারীর মধ্যে ভাইরাসটির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়াকে বোঝানো হয়েছে। মনে রাখতে হবে, বাজারে প্রচলিত মডার্না, ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার সম্পূর্ণ ডোজ ডেল্টাসহ অন্যান্য ধরনের বিরুদ্ধে গুরুতর সংক্রমণ রোধে অত্যন্ত কার্যকর।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এফডিএ টিকার তৃতীয় ডোজ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নাকচ করে দিয়েছে। এমন সিদ্ধান্তের মূল কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের কেন্দ্রের (সিডিসি) সাম্প্রতিক গবেষণায় অনুযায়ী চলতি বছরের ২ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৬৬ মিলিয়ন মানুষ করোনার দুটি ডোজ নিয়েছেন। এদের মধ্যে ৭ হাজার ১০১ জন (শতকরা ০.০০৫ ভাগ) গুরুতর করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ১ হাজার ৫০৭ জন (শতকরা ০.০০১ ভাগ) মৃত্যুবরণ করেছেন।
এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, করোনা টিকার দুটি ডোজ গুরুতর সংক্রমণ প্রতিরোধে শতকরা ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগ কার্যকর। টিকার ডোজ সম্পন্ন করার পরও যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৭৪ ভাগের বয়স ৬৫ বছরের বেশি এবং এসব ব্যক্তি যে কোনো কারণেই হোক শরীরে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে না। Immunocompromized individuals, যাদের organ transplant হয়েছে— এমন রোগীদের ক্ষেত্রে করোনার ঝুঁকি এড়াতে এফডিএ ১২ আগস্ট এমআরএনএ টিকার তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে।
এখানে সতর্ক থাকতে হবে, জনসন অ্যান্ড জনসন বা অ্যাস্ট্রাজেনেকার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বুস্টার ডোজ প্রযোজ্য হবে না। কারণ এ পর্যন্ত এসব টিকার বুস্টার ডোজ সংক্রান্ত কোনো গবেষণা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে এবং Immunocompromized প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষকে এমআরএনএ টিকার তৃতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে। ইসরায়ের একটি পৃথক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের ফাইজারের তৃতীয় ডোজ দেওয়ার পর করোনা সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। সুতরাং, এমআরএনএ টিকার তৃতীয় ডোজ শুধুমাত্র ৬০ বছরের বেশি মানুষের ক্ষেত্রে চিন্তা করা যেতে পারে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কী করোনা মহামারী শেষ হয়ে গেল? এটি এখনো নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ এমন কোনো নতুন ধরন আসবে না যার বিপরীতে টিকার কার্যকারিতা কম পরিলক্ষিত হবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশে ল্যামডা নামে নতুন আরেকটি ধরনের সন্ধান মিলেছে।
জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ল্যামডা ধরনের স্পাইক প্রোটিনে ‘টি৭৬আই’ ও ‘এল৪৫২কিউ’ জাতীয় দুটি জিনগত পরিবর্তন থাকায় এটি ডেল্টা থেকে বেশি সংক্রামক। এছাড়া ল্যামডার স্পাইক প্রোটিনে সাতটি এমাইনো এসিড অপসারণ (deletion) পরিলক্ষিত হয়েছে, যার কারণে এটি বর্তমানে প্রচলিত টিকার মাধ্যমে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দিয়ে শরীরে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।
এটি নিয়ে এখন বিস্তারিত গবেষণা চলছে। বিস্তারিত তথ্য জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। এ গবেষণার ফলাফল শেষ পর্যন্ত সঠিক প্রমাণিত হলে এবং ল্যামডা ধরনের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়লে টিকার নতুন আরেকটি ডোজ নেওয়ার সম্ভাবনা উপেক্ষা করা যাবে না। ফলে করোনা প্রতিরোধে এখন শুধু একটিই মন্ত্র— টিকা নিন নতুন ধরনের আবির্ভাব বন্ধে সাহায্য করুন।
লেখক: মোহাম্মাদ শামসুল আলম, পিএইডি
স্টাফ সায়েন্টিস্ট,
ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ, যুক্তরাষ্ট্র।
ই-মেইল: msalam100@yahoo.com