হোমিওস্ট্যাসিস, ইনফ্লামেশন এন্ড প্রেয়ারস

হামীম ইবনে কাওছার
2021-09-03 18:58:51
হোমিওস্ট্যাসিস, ইনফ্লামেশন এন্ড প্রেয়ারস

তিনিয়ত আমাদের শরীরের এই বাইরের পরিবেশ এবং ভিতরের পরিবেশের মধ্যে ‘ক্রস টক’ হয়

এক

আমরা একটা বাহ্যিক পরিবেশে বাস করি, যা আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-মানুষ-আবহাওয়া-খাদ্য এসবের সমন্বয়ে গঠিত। ঠিক একই ভাবে, আমাদের শরীরের ভিতরও একটা পরিবেশ আছে। আমাদের শরীর সেই পরিবেশের মধ্যেও বাস করে। এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ। প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরের এই বাইরের পরিবেশ এবং ভিতরের পরিবেশের মধ্যে ‘ক্রস টক’ হয়।

বাইরের পরিবেশ প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরের ভিতরের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে, প্রভাবিত করে। কিন্তু, এর পরেও আমাদের শরীরের ভিতরের পরিবেশ চেষ্টা করে সবসময় যতটা সম্ভব একই রকম থাকতে, যাতে আমাদের শারীরবৃত্তিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।  এই স্বাভাবিক রাখাকে বলে "হোমিওস্ট্যাসিস"

দুই

আমাদের শরীর সার্বক্ষণিক একটি প্রতিকূল বাহ্যিক পরিবেশে বাস করে। সদা-সর্বদা আমাদের প্রতিকূল পরিবেশ, জীবাণু, দূষিত খাদ্য, বাতাস, স্ট্রেস, ভাবনা, দুশ্চিন্তা- এসবের সাথে খাপ খাইয়ে আমাদের শরীরের ভিতর হোমিওস্ট্যাসিস বজায় রাখতে হয়। এই অবস্থা বজায় রাখতে আমাদের শরীরে অনেক রকম পরিবর্তন আনতে হয়, শরীরবৃত্তিক প্রক্রিয়ায়। এর মূল পরিবর্তনটা শুরু হয় জীন এক্সপ্রেশনের পরিবর্তনের মাধ্যমে।

এই পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করে সিস্- এবং- ট্রান্স-নিয়ন্ত্রকেরা এবং এপিজেনেটিক প্রক্রিয়া। যখন আমাদের শরীর ক্রমাগত প্রতিকূল বহি: পরিবেশের মধ্যে বাস করে, তখন কিছু জীন এক্সপ্রেশন বৃদ্ধি পায়, যেমন- সি রিয়াকটিভ প্রোটিন (সিআরপি), ইন্টারলিউকিন, টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর, ইত্যাদি। এদের একসাথে ‘ইনফ্লামেটরি সাইটোকাইন’ বলে, কারণ এদের উপস্থিতি শরীরে প্রদাহের ইঙ্গিত দেয়।

যে যত প্রতিকূল পরিবেশ (আবহাওয়া, জীবাণু, খাবার, স্ট্রেস, ইনফেকশন, দুর্বল ইম্যুনিটি)-এ বাস করে, তার শরীরে তত বেশি ইনফ্লামেটরি সাইটোকাইন তৈরি হয়। পপুলেশন স্টাডি তে দেখা গিয়েছে যে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের চেয়ে জাপানি মানুষের শরীরে এই ইনফ্লামেটরি সাইটোকাইনের পরিমাণ অনেক (প্রায় দুই থেকে তিনগুন) কম। এই সাইটোকাইন গুলো অনেক রোগের কারণ, বিশেষ করে হার্ট ডিজিজ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস।

তিন

যাদের শরীরে এই ইনফ্লামেটরি সাইটোকাইন বা ‘প্রদাহের মাত্রা’ বেশি থাকে, তাদের শরীরে রোগ বেশি, তাদের স্ট্রেস বেশি, দুঃখ বেশি, ডিপ্রেশন বেশি, মৃত্যু বেশি। যারা কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ, স্টাটিন খান, এই স্টাটিন কোলেস্টেরল কমানোর পাশাপাশি শারীরিক প্রদাহও কমায়। একারণেই হার্ট অ্যাটাক হলেই সঙ্গে সঙ্গে বেশি মাত্রার স্টাটিন শুরু করে দেয়া হয় যাতে দ্রুত প্রদাহ কমে। ঠিক একইভাবে এসপিরিন প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে।

এন্টি-প্লাটিলেট ভূমিকা ছাড়াও দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহকে ক্যান্সারের কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। একারণেই হয়তো দীর্ঘদিন এসপিরিন সেবনকারীদের মধ্যে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। ঠিক একইভাবে ডায়াবেটিসের ওষুধ মেটফরমিন-ও শরীরে প্রদাহ কমিয়ে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে।

ধারণা করা হয় পশ্চিমা জীবনযাত্রা শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের জন্য প্রতিকূল- বিশেষ করে ক্রমাগত স্ট্রেস, কম ঘুম, অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার, মানসিক প্রতিযোগিতা- এগুলো সবই শরীরের প্রদাহ বৃদ্ধি করতে পারে। ফলে তাদের শরীরে ইন্টারলিউকিন-৬, সি-রিয়েকটিভ প্রোটিন এবং টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টরের মাত্রা অনেক বেশি থাকে। মূলত এদের জীন এক্সপ্রেশন বৃদ্ধির মাধ্যমেই এটি সম্ভব হয়। এছাড়া বাইরের পরিবেশ- এপিজেনেটিক-জেনেটিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও প্রদাহ বৃদ্ধি হতে পারে।

চার

কিভাবে এই প্রদাহ কমানো যায়? এসপিরিন, মেটফরমিনের কথা বললাম। ব্যায়ামের মাধ্যমে, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তেনের মাধ্যমে এবং প্রার্থনার মাধ্যমে! প্রার্থনার মাধ্যমে? গবেষণায় দেখা গেছে যে, যাদের ‘আধ্যাত্মিক তকলিফ’ আছে (অর্থাৎ যাদের স্রষ্টা বিশ্বাসে সমস্যা আছে, স্রষ্টার সাথে দুঃসম্পর্ক আছে, অন্য ধর্মভীরু মানুষের সাথে বিবাদ আছে, অথবা জীবনের চূড়ান্ত অন্তিম উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ আছে) তাদের শরীরে প্রদাহের সাইটোকাইন, ইন্টারলিউকিন-৬ এর মাত্রা বেশি থাকে।

বিভিন্ন গবেষণার মেটা এনালাইসিস করে দেখায় গিয়েছে যে প্রার্থনার সাথে সুস্বাস্থের নিবিড় সম্পর্ক আছে। ২০১৬ সালের প্রকাশিত এই প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে, যারা প্রার্থনা করে তাদের মধ্যে কম নিঃসঙ্গতা এবং হতাশা থাকে, যা অনেক রোগের কারণ।

প্রার্থনা করা রোগীরা অন্য রোগীর চেয়ে কম দিন হাসপাতালে থাকেন। এখানে ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা এবং প্রার্থনার পার্থক্য বোঝা দরকার।  ধর্ম-আধ্যাত্মিকতার তিনটি মাত্রা আছে; আবেগ, জ্ঞান এবং আচরণ। অন্যদিকে, প্রার্থনা হলো আচরণের প্রকাশ।  আবেগ এবং জ্ঞান ছাড়াও প্রার্থনা করা সম্ভব, কিন্তু শুধু প্রার্থনা দিয়েই ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা ধারণ করা যায় না।

পাঁচ

প্রার্থনায় কী বলবেন? আপনি স্বাস্থবান, ধনী, সুখী এবং সফল হতে চান?, ২০১৬ সালের এক মজার গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, যারা অন্য মানুষের জন্য দোয়া করে, তাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশে প্রদাহ কমে যায় এবং তাদের ইনফ্লামেটরি সাইটোকাইন, সি-রিয়েকটিভ প্রোটিন-এর মাত্রা কমে স্বাভাবিক হয়ে আসে।

দারুন না আইডিয়া টা? নিজের সুস্থ্যতা চাইতে অন্যের জন্য দোয়া করা! মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের  তিন হাজার মানুষের উপর করা গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যারা বেশি প্রার্থনালয়ে যায় তারা তাদের স্রষ্টার প্রতি বিশ্বস্ত হয়, যারা স্রষ্টার প্রতি বেশি বিশ্বস্ত থাকে তারা অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, যারা অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় তারা অন্যকে আবেগী আশ্রয় দেয়, যারা অন্যের আশ্রয়স্থল হয়, তারা সুখী হয়।

২০০২ সালে সাউথ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, যেসব ডায়াবেটিস রোগী নিয়মিত উপাসনালয়ে যায়, তাদের সি-রিয়েকটিভ প্রোটিন, ডায়াবেটিস রোগী যারা প্রার্থনালয়ে যায় না, তাদের থেকে অনেক কম থাকে।  সি-রিয়েকটিভ প্রোটিন যাদের কম থাকে, তাদের শরীরে প্রদাহ কম, হৃদরোগ কম, স্ট্রোক কম! হতাশাতো কমই! প্রার্থনায় যে আমাদের জীন এক্সপ্রেশন প্রোফাইল পরিবর্তন হয়, তা দেখানো হয়েছে ২০১৭ সালে।

মজার ব্যাপার হলো, আমরা ব্যথার জন্য বা প্রদাহের জন্য যে ঔষুধগুলো খাই- এই সব ঔষধ যে সব প্রোটিনের উপর কাজ করে তাদের অকার্যকর করে দেয়, প্রার্থনা ঠিক সেই প্রোটিনগুলোর জিন এক্সপ্রেশন বন্ধ করে দিয়ে প্রদাহের প্রোটিনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।  এতে প্রমাণ করে প্রার্থনা প্রদাহনাশক, বেদনানাশক। প্রার্থনার এই ‘মলিকিউলার সিগনেচার’ নিয়ে এখনো গবেষণা হচ্ছে।

ছয়

কী প্রার্থনা করবেন?  কিভাবে করবেন? প্রার্থনায় কী চাইবেন? আপনার ধর্মে কী বলেছে? নিজের সফলতা, নিজের ক্ষমতা, নিজের অর্থবিত্ত? নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ? কিন্তু সুখ আসবে কোথা থেকে? বেদনানাশ-প্রদাহনাশ হবে কোথা থেকে? ট্রাংকুইলিটি আসবে কিভাবে? ‘সাকিনা’ (অর্থাৎ মনের শান্ততা এবং প্রশান্তি) আসবে কিভাবে? প্রার্থনায় আমাদের হতাশা কমবে, রোগমুক্তি হবে, প্রদাহনাশ হবে, বেদনানাশ হবে।

আপনার জিন এক্সপ্রেশন প্রোফাইল হবে অন্যের চেয়ে ভিন্ন। প্রার্থনায় অন্যের ভালো কামনায় আসবে প্রশান্তি। আত্মার প্রশান্তি। আমাদের প্রার্থনা হওয়া দরকার অন্যের ভালো কামনার জন্য। এতেই অসীম অবারিত ভালোয় পরিবেষ্টিত হবে আমাদের নিজেদের জীবন!

[এমন কোনো বিশ্বাসী নেই যে তার ভাইয়ের জন্য তার অগোচরে দোয়া করে অথচ ফেরেস্তারা বলে না যে তুমি তোমার ভাইয়ের জন্য যে দোয়া করেছো ঠিক তাই তোমার জন্যও হোক। - সহীহ মুসলিম, #৬৫৮৮]


আরও দেখুন: